অর্থনীতির সূচকগুলোর সবশেষ অবস্থা বিশ্লেষণ করে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি প্রায় চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; গত কয়েকবারের মত এবারও মূল চ্যালেঞ্জ পরপর দুই অর্থবছর ধরে ৯ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতিকে বশে আনা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবশেষ দুই অর্থবছরে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে সুদহার বাড়াতে একের পর এক রেপো বাড়ালেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা হিমশিম খাচ্ছে। সরকারের নানান উদ্যোগও মূল্যস্ফীতির পারদকে দমাতে পারেনি।
এমন প্রেক্ষাপটে আগামী বৃহস্পতিবার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দীর্ঘদিনের রেওয়াজ ভেঙে এবার সংবাদ সম্মেলন না করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে মুদ্রানীতি প্রকাশ করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত মে মাসে সুদহার ঠিক করার বিষয়টি বাজারের ওপর দিয়েছে। একই সঙ্গে ডলারের দর নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি ‘ক্রলিং পেগ’ চালু করে। এতে এক লাফে সাত টাকা বেড়ে ডলারের দর পৌঁছে ১১৭ টাকায়, যেটিকে নতুন পদ্ধতিতে ‘মধ্যবর্তী দর’ বলছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসময়ে বাড়ানো হয় নীতি সুদহারও।
মুদ্রানীতি মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় চূড়ান্ত করা হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে মুদ্রানীতি কেমন হচ্ছে সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম সুস্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
তিনি বলেন, নীতি সুদহার বাড়ানো হবে কি না তা জানা নেই তার।
এরপরও মূল্যস্ফীতির পারদ নিম্নমুখী না হওয়ায় আসন্ন মুদ্রানীতিতেও নীতি সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপ আসার আভাস মিলছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কথায়।
তবে তারা নীতি সুদহার বাড়ানোর বাড়ানোর পাশাপাশি আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তারা বলেন, মূল্যস্ফীতি তখনই কমবে যখন অর্থনীতির অন্যান্য সূচক নিয়মের মধ্যে রাখা সম্ভব হয়। শুধু নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কারণ এর সঙ্গে বাজার তদারকিসহ আরও অনেক বিষয় জড়িত।
বর্তমানের রেপো বা নীতি সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশ থেকে আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “এটা আরও বাড়ানো উচিত বলে আমি মনে করি। যতদিন মূল্যস্ফীতি না কমে ততদিন ধীরে ধীরে নীতি সুদহার বাড়াতে হবে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, আবার নীতিসুদহার বাড়ালেই যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে সেটাও বলা যায় না। কারণ অন্যান্য আরও বিষয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রতিপালন করতে হবে, যা বর্তমানে হচ্ছে না।
মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়। বিষয়টি হল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি মনে করে, বাজারে অর্থের সরবরাহ বেশি এবং সে কারণে মূল্যস্ফীতির সূচক বাড়ছে, তাহলে অর্থপ্রবাহ কমাতে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
নীতি সুদহার বাড়ানোর অর্থ হল-ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত সুদ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হবে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে ঋণ দেয় সেটির সুদহার বাড়ে। এতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে নিরুৎসাহিত হয়।
জাহিদ হোসেন বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সাল থেকে ক্রমাগতভাবে নীতিসুদহার বাড়িয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সম্ভব হয়নি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যর্থ।”
’সুদহার নির্ধারণের পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট করতে হবে’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি বছর ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণের পদ্ধতি স্মার্ট (সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল) থেকে সরে আসে। এরপর বাজারভিত্তিক সুদহার পদ্ধতি চালু করা হয়।
সুদহার নির্ধারণে গত কয়েক বছরে বারবার নীতি পরিবর্তনের মধ্যে তা এখনও পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, এখনও ব্যাংক ঋণের সুদহারে হস্তক্ষেপ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ গভর্নর ব্যবসায়ীদের আশ্বাস দিয়েছেন ব্যাংক ঋণের হার ১৫ শতাংশের ওপর উঠবে না।
তিনি বলেন, ” তাহলে তো বাজারভিত্তিক সুদহার হল না। তাতে বোঝা যাচ্ছে ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশের ওপর ব্যাংক ঋণ উঠবে না।”
তার ভাষ্য, নয়-ছয় সুদহার নীতির সময় ব্যাংক ঋণ অনেক সস্তা ছিল। তখন অনেক ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বাইরে পাচার করেছে। সেসময় তারা সুবিধা নিয়েছে। আর ব্যাংকের টাকা খালি হয়ে গেছে।
এমন অবস্থায় ব্যাংক ঋণের সুদহার নির্ধারণের পদ্ধতি আসলে কী রকম তা বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে পরিষ্কার করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
’ব্যাংককে টাকা ধার দেওয়া বন্ধ করতে হবে’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের একটি অন্যতম উপায় বাজারে টাকার সরবরাহ কমানো। এজন্য কেন্দ্রীয় নীতি সুদহার বাড়ায়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়ায় তা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ” নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তই সাংঘর্ষিক। একদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন ধরে নীতি সুদহার বাড়িয়ে আসছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে। অন্যদিকে কিছু ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে টাকা সরবরাহ করছে। তাহলে তো মূল্যস্ফীতি কমবে না। এসব ব্যাংকগুলোকে টাকা সরবরাহ করা বন্ধ করতে হবে। কারণ টাকার সরবরাহ অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি কখনই কমবে না।”
নিত্যপণ্যের বাজার সিন্ডিকেটও বন্ধ করা জরুরি মন্তব্য করে তিনি বলেন, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয়। এটা করতে হবে সরকারকে।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিয়েই যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাতে অর্থনীতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এসব ব্যাংক ঋণ দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। তাও আবার এমন গ্রুপকে টাকা ধার দিচ্ছে যে ব্যাংকে টাকা আর ফেরত আসছে না।”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, টাকা ছাপিয়ে সরকারকে দেওয়া বাজেট সহায়তা গত অর্থবছরের মত বন্ধ রাখা অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ এটি মূল্যস্ফীতিকে চড়তে সহায়তা করে।
তার মতে, ইসলামি শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে তারল্য সহায়তা দিচ্ছে তা ছাপা টাকার সমতুল্য। ফলে এসব ব্যাংকগুলোকে তারল্য সহায়তা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। নতুবা যতই নীতিসুদহার বাড়ানো হোক না কেন, মূল্যস্ফীতি আর কম্বে না।
‘স্থিতিশীল রাখতে হবে ডলার বাজার’
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা মনে করছেন, ডলারের দর নির্ধারণে ক্রলিং পেগ ভূমিকা রাখছে। কারণ সংকট একেবারে কমে না গেলেও ডলার বাজারের ওপর চাপ কমেছে।
এ বিষয়ে আহসান মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ক্রলিং পেগের মধ্যবর্তী দর ১১৭ টাকার মধ্যে রাখা যেতে পারে। খুব বেশি পরিবর্তন না আনলেও চলবে। কারণ রিজার্ভ বাড়ানো ও বৈদেশিক বিনিয়োগ পাওয়ার জন্য ডলার দর স্থিতিশীল রাখা জরুরি।
তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণ উচ্চ থাকলেও ঋণের সুদহারের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ না করলে ডলার বাজার স্থিতিশীল থাকবে। এছাড়া রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করা আগের চেয়ে বাংলাদেশ কমিয়েছে। তবে এটা পুরোপুরি বন্ধ করা জরুরি।
ব্যাংক খাত সংস্কারের পরামর্শ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন মনে করেন, ব্যাংকখাত সংস্কার নিয়ে মুদ্রানীতিতে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কিছু উল্লেখ থাকে না। ব্যাংকখাত দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। আসলে এ হিসাব আরও অনেক বেশি।
তিনি বলেন, একদিকে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির মানুষ, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেসব ব্যক্তিকে ছাড় দিয়ে যাচ্ছে। আবার তারল্যসংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকেও তারল্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে মুদ্রানীতিতে এসব বিষয় সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও সমাধান না করলে কোনো ধরনের নীতিই আসলে কাজে আসবে না।
Discussion about this post