নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় মাধ্যমিক শ্রেণির ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন পরীক্ষা গত ৩ জুলাই শুরু হয়েছে। তবে এ পরীক্ষার আগে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এমনকি এসব প্রশ্নের সমাধানও পাওয়া গেছে ফেসবুক ও ইউটিউবে। শুধু প্রথম পরীক্ষাতেই নয়, গত শনিবার ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি, সপ্তম শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি, অষ্টম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নবম শ্রেণির ডিজিটাল প্রযুক্তি পরীক্ষার প্রশ্নও আগের রাতে ফাঁস হয়। তবে প্রশ্ন প্রণয়নকারী জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এবং এ পরীক্ষা অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) কেউই এর দায় নিতে রাজি নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান শিক্ষকদের উদাসীনতার কারণে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে। এনসিটিবি থেকে তাদের কাছে পরীক্ষার আগের দিন প্রশ্ন পাঠানো হয়। তারা নিজের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ওপেন এবং ডাউনলোড করেন। মফস্বলে ও গ্রামে বেশির ভাগ প্রধান শিক্ষকের নিজের কম্পিউটার বা ল্যাপটপ নেই। তারা বাজারের কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করছেন। এ সময় প্রশ্ন অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ছে। আগামী ৩ আগস্ট পর্যন্ত এ পরীক্ষা চলবে। প্রতি পরীক্ষার আগের দিনই সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ছে। একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় চরম বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা।
এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকবেন বলেও জানান তিনি।
একই অভিযোগ উঠেছে খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার হাজী ছায়েম উদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধেও। সেখান থেকে নবম শ্রেণির ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রশ্নটি ফাঁস হয়েছে। ইউটিউবে সেই প্রশ্নের সমাধানও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুরের জাফরনগর ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা ও সিরাজগঞ্জের বড়কোয়ালীবেড় উচ্চ বিদ্যালয় থেকেও প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। এভাবে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, যা দেখে অনেক শিক্ষার্থী বাড়ি থেকেই প্রশ্ন সমাধান করে পরীক্ষার হলে গিয়েছে বলে জানান অভিভাবকরা। শিক্ষার্থীদের হাতে মোবাইল ফোন থাকায় তারা নিষেধ করেও পারছেন না। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগের দিন পড়াশোনা না করে গভীর রাত পর্যন্ত ইউটিউব-ফেসবুকে প্রশ্নের উত্তর খোঁজে।
জানা গেছে, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শুরুর আগের দিন গত মঙ্গলবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মেইলে প্রশ্ন পাঠায় এনসিটিবি। সেই প্রশ্নের ফটোকপি করে পরদিন পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপের মাধ্যমে দেওয়া হয়, শিক্ষকরা এটা পরিচালনা করেন। নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অগ্রগতির রেকর্ড রাখার জন্য শিক্ষকরা এই অ্যাপটির লগইন সুবিধা পান।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক বলেন, পরীক্ষার আগের দিন অ্যাপের মাধ্যমে প্রশ্ন আসে। সেগুলো ছাপিয়ে পরীক্ষা নিতে হয়। তবে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা না করে ইউটিউবে উত্তর দেখে প্রশ্নের সমাধান করে আসছে। এর ফলে আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া একই উত্তর অনেকে লিখছে। ফলে নিজের অর্জিত জ্ঞান কোনো কাজে আসছে না।
এনসিটিবির একটি সূত্র জানায়, গ্রামাঞ্চলের অনেক প্রধান শিক্ষকের প্রযুক্তিগত জ্ঞান সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। ফলে প্রশ্ন ডাউনলোড ও প্রিন্ট করার ক্ষেত্রে অন্য শিক্ষক বা কর্মকর্তার সহযোগিতা নিয়ে থাকেন। সেই সুযোগে অনেকেই প্রশ্নের ছবি তুলে তা নিজের পেজ বা ইউটিউবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাটি এখান থেকেই শুরু হচ্ছে। পরে গিয়ে প্রধান শিক্ষকরা বিষয়টি জানতে পারছেন।
এ নিয়ে অভিভাবকরা তাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করার পরিবর্তে পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন খোঁজাখুঁজি করছে। তারা পড়ার চেয়ে এখন প্রশ্ন খুঁজতে বেশি সময় ব্যয় করছে। দীর্ঘ এক মাস ধরে ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির পরীক্ষার মাধ্যমে অলস হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এমনকি ৪-৫ ঘণ্টা ধরে পরীক্ষাও খুব একটা সুফল মিলছে না।
যেসব ইউটিউব চ্যানেলে মিলছে প্রশ্নের সমাধান
প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার পর বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাচ্ছে। সেসব চ্যানেলের ‘ভিউ’ও অনেক। এই ধরনের বেশ কয়েকটি চ্যানেলের সন্ধান পেয়েছে সমকাল। সেগুলো হলো– ‘ম্যাথ ফার্মা’, ‘শিক্ষক বাতায়ন টিভি’, ‘খান’স আইসিটি পয়েন্ট’, ‘টিচিং রুম’, ‘মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’, ‘জহির’স লাইব্রেরি’, ‘কোড হর্স’ ইত্যাদি।
যা বলছে কর্তৃপক্ষ
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, ষাণ্মাসিক মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের কিছু কাজ করতে হয়। এটা কেউ লিখে দিলে বা না দিলেও কিছু আসে যায় না। আমাদের প্রশ্নের ধরন হচ্ছে ‘ওপেন বুক অ্যাসেসমেন্ট’। পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীরা চাইলে বইও নিয়ে যেতে পারবে। তো প্রশ্ন আগে বের হওয়া কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে, যেসব সমাধান ফেসবুক বা ইউটিউবে দেওয়া হয়, সেসব শিক্ষার্থীদের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দেয়। এমনকি শিক্ষকরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে। তারা ফেসবুক বা ইউটিউবে যেসব উত্তর দেওয়া হয়, সত্যিকারের উত্তর সেটাই হবে কিনা কিংবা সেটা না হলে কীভাবে নম্বর দেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে সন্দিহান থাকেন– এটা হচ্ছে সমস্যা।
তিনি আরও বলেন, গত বছর যখন আমরা পরীক্ষা নিয়েছি, তখন ১৫ দিন আগে প্রশ্ন ওয়েবসাইটে দিয়েছিলাম। তখন ইউটিউবের সমাধান নিয়ে শিক্ষার্থীরা দ্বিধায় পড়ায় এবার পরীক্ষার আগের দিন নৈপুণ্য অ্যাপের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকদের প্রশ্ন পাঠানো হয়েছে। তাদের প্রশ্নগুলো সংরক্ষণ করার কথাও জানানো হয়েছিল। তা ছাড়া কোনো শিক্ষকও যেন সেটা দেখতে না পারেন, এ কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু সেটা হয়নি। এ কারণে গত ৪ এপ্রিল একটি নোটিশ প্রধান শিক্ষকদের পাঠানো হয়েছে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, নৈপুণ্য অ্যাপে আমরা একটা প্রসেস তৈরি করেছি, যাতে করে যেই প্রধান শিক্ষক প্রশ্ন ডাউনলোড করবেন, তাঁর ইআইআইএন নম্বরটাও সেখানে উঠে যাবে। ইআইআইএন নম্বরটি প্রশ্নে থাকায় ফেসবুকে যারা প্রশ্ন দিয়েছেন, তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আমরা পেয়েছি। এ ধরনের কিছু তথ্য আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠিয়েছি। অধিদপ্তরকে আমরা এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। এ বিষয়ে অধিদপ্তরই ব্যবস্থা নিতে পারে। অধিদপ্তর পদক্ষেপ নিলে প্রধান শিক্ষকরা সতর্ক হবেন।
প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক জাফর আলী সমকালকে বলেন, আমরা একটা প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করেছি। সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে আবার এমন ঘটনার তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেব।
Discussion about this post