রুবেল সরকার : বনবিভাগ যেন গভীর বনের মতোই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ছে। এই সেক্টরে দুর্নীতি ও লুটপাট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা সহজে প্রকাশ পায় না। সুফল প্রকল্প, বনায়ন প্রকল্প কিংবা রাজস্ব খাতের বরাদ্দের টাকা কাগজে-কলমে কাজ দেখিয়ে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। রেঞ্জ কর্মকর্তা, স্টেশন কর্মকর্তা ও বিভাগীয় কর্মকর্তারা ঘুষের মাধ্যমে পোস্টিং নিয়ে জবরদখলে সরাসরি সহযোগিতার করায় সংকুচিত হচ্ছে বনভূমি, নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী এবং অভয়ারণ্য হারিয়ে গেছে। বিলুপ্ত প্রজাতির প্রায় শতাধিক প্রাণী চরম সংকটে পড়েছে পরিবেশ ও প্রকৃতি।
অভিযোগ আছে, প্রধান বন সংরক্ষক আমির হোসাইন চৌধুরী সিন্ডিকেটে পোস্টিং বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কোটি টাকা। যার কারণে বনবিভাগ আজ ধ্বংস প্রায়। তার সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হলেন ঢাকা সামাজিক বন অঞ্চলের বন সংরক্ষক এস এম মনিরুল ইসলাম। এই দুর্নীতি চক্রের নেপথ্যে ছিলেন, সাবেক বনমন্ত্রী সাহাব উদ্দিন এবং তার ছেলে জাকির হোসেন জুমন।
বনবিভাগের একটি সূত্র বলছে, পোস্টিং বাণিজ্যের মাধ্যমে সাবেক বন মন্ত্রী সাহাব উদ্দিনের আমলে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকা বাণিজ্য করেছে প্রধান বন সংরক্ষকের এই সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের নৈপথ্যে নায়ক ছিলেন মন্ত্রী সাহাব উদ্দিনের ছেলে জাকির হোসেন জুমন। বাবা মন্ত্রী হওয়ার পরই জুমন লন্ডন থেকে দেশে চলে আসেন। ঢাকায় বাবার বাসায় থেকে মন্ত্রণালয় ও বনবিভাগের বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ শুরু করেন জুমন। মাত্রাতিরিক্ত ঘুষ গ্রহণের কারণে তাকে বনবিভাগের অনেকেই জুম্মন কসাই হিসেবে চিনেন বলে জানিয়েছেন একাধিক কর্মকর্তা।
বদলী বাণিজ্যে বৈষম্যের শিকার মাঠ পর্যায়ের একাধিক ফরেস্টার ও বন প্রহরীরা জানান, গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের দোসর প্রধান বন সংরক্ষকের বিরুদ্ধে ঢাকার বন ভবনে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচি ঘোষণার পরপরই প্রধান বন সংরক্ষক কৌশলে বৈঠকের মাধ্যমে সবাইকে শান্ত করেন। তাদের দাবী, এখনো পোস্টিং বাণিজ্যের মাধ্যমে সিনিয়র ফরেস্টারদেও রেঞ্জ এবং চেক পোষ্টের দায়িত্ব না দিয়ে জুনিয়র ফরেস্টার এবং ফরেস্ট গার্ডদের ভালো জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হচ্ছে। পোস্টিং বৈষম্য সমাধান না হলে যেকোন সময় কঠোর আন্দোলন হতে পারে বলে ধারনা করছেন মাঠ পর্যায়ের বন সংরক্ষকরা।
সূত্র বলছে, কর্মকর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী বন অঞ্চলের বিভিন্ন রেঞ্জ, স্টেশন ও বিভাগীয় বনবিভাগকে বনভূমি অনুযায়ী প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে ভাগ করা থাকে। দুই বছরের জন্য প্রথম শ্রেণীর বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য ১৫ লাখ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর রেঞ্জ কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য জন্য ১০ লাখ ও তৃতীয় শ্রেণীর রেঞ্জ কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য নেওয়া হয় ৫ লাখ টাকা। এছাড়াও এক বছরের প্রথম শ্রেণীর চেকপোস্টে স্টেশন কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য ২০ লাখ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেনীর চেকপোস্টে স্টেশন কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য ১০ লাখ টাকা ও তৃতীয় শ্রেণীর চেকপোস্টে স্টেশন কর্মকর্তাদেও পোস্টিংয়ের জন্য নেওয়া হয় ৫ লাখ টাকা। দুই বছরের জন্য প্রথম শ্রেণীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা পোস্টিংয়ের জন্য ৫০ লাখ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তার পোস্টিংয়ের জন্য ৩০ লাখ টাকা ও তৃতীয় শ্রেনীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদেও পোস্টিংয়ের জন্য নেওয়া হয় ২০ লাখ টাকা করে।
শুধু পোস্টিং বাণিজ্যেই সীমাবদ্দ নেই এই সিন্ডিকেট। বদলী নীতিমালা অনুযায়ী স্টেশন পোস্টিংয়ের এক বছর ও রেঞ্জ এবং বিভাগীয় কর্মকর্তার পোস্টিংয়ের দুই বছর মেয়াদ শেষ হলে শুরু হয় নতুন বাণিজ্য। নির্দিষ্ট মেয়াদ পেরিয়ে গেলে নতুন পোস্টিং না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে রেঞ্জ কর্মকর্তা, চেক স্টেশন কর্মকর্তা ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের মাসিক মাসোহারা দিতে হয় বলে জানিয়েছেন খোদ বন বিভাগের এই কর্মকর্তারা।
এদিকে, বিপুল কৃষ্ণ দাসের বদলীর আদেশ হাতে আসার আগে গত ২৫ জুলাই কোটি টাকার বিনিময়ে তার নিজস্ব বলয়ের প্রায় ডজন খানেক ফরেস্টারকে লোভনীয় পদে পোস্টিং দেন। তার মধ্যে দশ জনের তালিকা এসেছে প্রতিবেদকের হাতে। তাদের মধ্যে উপকূলীয় বনবিভাগের ফরেস্টার মোঃ মোজাম্মেল হক সরকারকে লামা বনবিভাগে, ফরেস্টার এইচ এম জলিলুর রহমানকে বান্দরবান বনবিভাগে ও খন্দকার আরিফুল ইসলামকে লামা বনবিভাগে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের মোঃ আরিফুল ইসলামকে পাল্পউড বনবিভাগে, আশরাফুল ইসলামকে লামা বনবিভাগে ও ফরেস্টার মোঃ মঞ্জুর মোর্শেদকে ব্যাবহারিক বন বিভাগে। পাল্পউড বন বিভাগের ফরেস্টার অভিজিত কুমার বড়ুয়াকে ব্যাবহারিক বন বিভাগে, ব্যাবহারিক বন বিভাগের ফরেস্টার মোঃ রাফি উদ দৌলা সারদারকে বান্দরবান বনবিভাগে, লামা বনবিভাগের ফরেস্টার এস এম রেজাউল ইসলামকে চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগে পোস্টিং দেওয়া হয়।
বনবিভাগের বদলী নীতিমালা ২০০৪ অনুযায়ী, চেক স্টেশনে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা এক বছর, রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এক কার্যালয়ে দুই বছর জন্য দায়িত্ব পালনের বিধান রয়েছে। অভিযোগ আছে, কোন কোন চেক স্টেশনে এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত বদলী নীতিমালা বহির্ভূত অতিরিক্ত সময়ের মাসোহারা দিয়ে দায়িত্ব পালন করেন কর্মকর্তারা। যদিও চেকস্টেশনের কর্মকর্তাদের অধীনস্থ কর্মচারীদেও বেলায় এক বছরের বদলী নীতিমালার দোহাই দিয়ে বদলী করা হয় বলে জানিয়েছেন অনেকেই।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তাদের এসব লোভনীয় পোস্টিংয়ের মধ্যে রয়েছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ বনবিভাগ, চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ, চট্টগ্রাম বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বনবিভাগ, বান্দরবান পাল্পউড বন বিভাগ, বান্দরবান বন বিভাগ, লামা বনবিভাগ। রাঙ্গামাটি অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগ, জুম নিয়ন্ত্রণ বনবিভাগ, ইউএসএফ বনবিভাগ ও খাগড়াছড়ি বনবিভাগ।
চেকস্টেশন কর্মকর্তাদেরও লোভনীয় পোস্টিয়ের মধ্যে রয়েছে, কুমিল্লা সামা জিক বনবিভাগের সোয়াগাজী ফরেস্ট চেক স্টেশন। খাগড়াছড়ি বনবিভাগের রামগড় ফরেস্ট চেক স্টেশন। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের নলবিলা ফরেষ্ট চেক স্টেশন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের পুদয়া ও বড়দোয়ারা ফরেস্ট চেক স্টেশন। চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের রাউজান ঢালা চেক স্টেশন, হাটহাজারি ফরেস্ট চেক স্টেশন, ফৌজদার হাট ফরেস্ট চেক স্টেশন, করের হাট চেক স্টেশন ও ধুমঘাট ফরেস্ট চেক স্টেশন। ঢাকা সামাজিক বনবিভাগের সোনারগাও ফরেস্ট চেক স্টেশন।
টাঙ্গাইল বনবিভাগের করটিয়া ফরেস্ট চেক স্টেশন। রাঙ্গামাটি অঞ্চলের দক্ষিণ বনবিভাগের কাপ্তাই জেটি ঘাট চেক স্টেশন, ঘাগরা ফরেস্ট চেক স্টেশন ও সুবলং ফরেস্ট চেক স্টেশন।
রেঞ্জ কর্মকর্তাদেও লোভনীয় পোস্টিংয়ের মধ্যে রয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ বনবিভগের সদর রেঞ্জ। রাঙ্গামাটি বন বিভাগের সবগুলো রেঞ্জ। ঢাকা সামাজিক বনবিভাগ সদও রেঞ্জ। টাঙ্গাইল সদর রেঞ্জ। ময়মনসিংহ ভালুকা রেঞ্জ। ঢাকা বনবিভাগের কালিয়াকৈর রেঞ্জ ও শ্রীপুর রেঞ্জ। সুন্দরবন অঞ্চলের খুলনা রেঞ্জ, সাতক্ষীরা রেঞ্জ, চাদপাই রেঞ্জ ও শরণখোলা রেঞ্জ। কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের ঈদগাহ রেঞ্জ ও ফুলছড়ি রেঞ্জ। কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের টেকনাফ রেঞ্জ, হোয়াইক্যং রেঞ্জ, উখিয়া রেঞ্জ ও রাজাপালং রেঞ্জ। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের পটিয়া রেঞ্জ, রাঙ্গুনিয়া ও শহর রেঞ্জ। চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের সবগুলো রেঞ্জ। চট্টগ্রামের চুনতি বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জ ও বাশখালী বণ্যপ্রাণী রেঞ্জ। ঢাকা বণ্যপ্রাণী বিভাগের ভাওয়াল রেঞ্জ ও জাতীয় উদ্যান রেঞ্জ। নোয়াখালীর সকল উপকূলীয় রেঞ্জ।
এদিকে, চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগের উপ বন সংরক্ষক এস এম কায়চারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পত্তি অর্জন ও অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। হাজীপাড়া গ্রামের ইমাম বাড়ি এলাকায় তার বাড়ি। তার পিতা নুরুল কুদ্দুস পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু শিক্ষক পিতার আদর্শ ধরে রাখতে পারেননি এস এম কায়চার। টাকা কামানোর নেশায় তিনি বুঁদ হয়ে আছেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হাছান মাহমুদের এলাকার লোক পরিচয়ে রাতারাতি পদোন্নতি বাগিয়ে নেন তিনি। ২০০১ সালে ফরেস্ট অফিসার পদে যোগদান করে তিনি এখন উপ বন সংরক্ষক। হাছান মাহমুদ পরিবেশ ও বন মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ডিএফও পদে পদোন্নতি পান এস এম কায়চার। তার পরেই যেন পেয়ে যান আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। নামে বেনামে গড়ে তুলেন সম্পত্তির পাহাড়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাঙ্গুনিয়ায় তার নামে রয়েছে দেড় কানি জমি (৬০ শতক), যার মূল্য এক কোটি টাকা। ঢাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় রয়েছে ফ্ল্যাট, যার মূল্য এক কোটির ওপরে। চট্টগ্রাম কল্পলোক আবাসিকে রয়েছে তার তিনতলা বাড়ি। স্ত্রী সন্তানদের নামে বেনামে রয়েছে ব্যাংক ব্যালেন্স ও সম্পত্তি। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হাছান মাহমুদ ও তার ভাই রাঙ্গুনিয়ায় বনবিভাগের বিশাল জমি দখল কওে নেন। তার সহযোগিতায় ছিলেন চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা এস এম কায়চার।
অভিযোগ উঠেছে, দখলবাজিতে সহযোগিতার জন্য তাকে ভোলা থেকে চট্টগ্রামে বদলী করে আনেন হাছান মাহমুদ। ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদেও ছোট ভাই এরশাদ মাহমুদের দখল থেকে ২০০ একর বনবিভাগের জমি উদ্ধার করা হয়। যেখানে অবৈধভাবে মহিষের চারণভূমি, গয়াল পালন, মাল্টা ও কাজুবাদাম বাগান, মাছের খামার, পার্ক, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছিলেন তিনি। এদিকে সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন ও তার ছেলে জাকির হোসেন জুমনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাতপূর্বক অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা ইউনিট। গোয়েন্দা ইউনিটের অনুসন্ধানে মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আরও দুইজনের অনিয়ম-দুর্নীতি ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে। দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়নের পর অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর পতিত সরকারের সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন ও তার ছেলে জাকির হোসেন জুমনের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদকে সোর্স হিসেবে আমলে নিয়ে তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগগুলো অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট। অভিযোগটির প্রাথমিক অনুসন্ধানে সত্যতা পাওয়ায় সংস্থাটির দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেলের পরিচালক উত্তম কুমার মন্ডল অভিযোগটির পরবর্তী কার্যক্রম (প্রকাশ্যে তদন্ত) গ্রহণের জন্য গোয়েন্দা ইউনিটের প্রতিবেদনসহ মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) বরাবর চিঠি দিয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা (উপ-পরিচালক) আকতারুল ইসলাম জানান, দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। গোয়েন্দা ইউনিট সাবেক এই মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আরও দুইজনের দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে।
চট্টগ্রাম বনাঞ্চলের প্রধান হিসেবে (চট্টগ্রাম বন সার্কেলের) দায়িত্বে আছেন বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাশ। যিনি চট্টগ্রাম বন সার্কেলের ৯টি গুরুত্বপূর্ণ বনবিভাগের রক্ষণাবেক্ষণ, সংরক্ষণ, কাঠ পাচার রোধ, কর্মকর্তা-কর্মচারী বদলি-নিয়োগের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। চট্টগ্রাম শহরের নন্দনকাননে এই বন সংরক্ষকের দপ্তর। তিনি এই দপ্তরে বসে বান্দরবান বন বিভাগ, চট্টগ্রাম জেলার অধীন কক্সবাজার উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগ, পাল্পউড বাগান বিভাগ, লামা বন বিভাগ, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগ ও বন ব্যবহারিক বিভাগসহ চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এসব বন বিভাগের সফলতা ও ব্যর্থতার দায় দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে তার উপরেই বর্তায়। বন বিভাগের মূল কাজ বন-বাগান সৃজন, বন রক্ষা। কিন্তু এই বন সংরক্ষকের বিরুদ্ধে প্রতিটি স্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি, বদলি বাণিজ্য, কাঠ পাচার, পাচারকৃত কাঠ উদ্ধারে চরম অবহেলা ও ব্যর্থতার অভিযোগের অনুলিপি এসেছে গণমাধ্যমের হাতে। এতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রামে পাহাড় ঘেরা বনাঞ্চল আজ হুমকির সম্মুখীন, শুধু কাঠ আর কাঠ পাচার হচ্ছে অবাধে, অবৈধ কাঠে সয়লাব চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো। যে পয়েন্টগুলোতে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার কাঠ বাণিজ্য হয়ে থাকে।
কিন্তু এই ৯ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাঠ নির্বিচাওে কেটে চট্টগ্রাম হয়ে সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহনে করে পাচার করা হচ্ছে হরহামেশাই। এইসব দেখভালের সর্বোচ্চ দায়িত্বরত কর্মকর্তা হচ্ছেন বন সংরক্ষক নিজেই। কিন্তু তিনি তার ওপর অর্পিত দায়িত্বের উদাসীনতা ও চোরাই কাঠ পাচারের সিংহভাগ কমিশন প্রাপ্তির কারণে সবকিছুতেই তিনি নিরব ভুমিকা পালন করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। ঘুষের পয়েন্টগুলো হলো- চট্টগ্রাম শহরে ঢোঁকার পথে অক্সিজেনের এলাকার বিভিন্ন স’মিল। এসব স’মিলের কোন বৈধ লাইসেন্স নেই। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের হালিশহর এক্সেস রোডের মোখছেদুর রহমান (কাজল) সওদাগরের স’মিল। হাজী সুফিয়ানের স’মিল, বজল সওদাগরের স’মিল এবং পতেঙ্গা থানার অন্তর্গত কাঠগড় এলাকায় আব্দুল কাদেরের স’মিল। হালিশহরের সবুজ বাগের বিভিন্ন স’মিল, ফিরিঙ্গি বাজার চেয়ারম্যান ঘাটা রোডের জনতা স’মিল, বাংলাদেশ স’মিল।
এদিকে, কাপ্তাই রাস্তার মাথা হতে কালুরঘাট ব্রীজ পর্যন্ত রাস্তার দুই পার্শ্বে কমপক্ষে ২০টি স’মিল রয়েছে। বহাদ্দরহাট হতে নতুন ব্রীজ পর্যন্ত রাস্তার দুই পার্শ্বের অবৈধ কাঠের দোকান ও দোকানের গোডাউন সমূহ এবং স’মিল সমূহে প্রচুর অবৈধ মূল্যবান কাঠ অবৈধভাবে এসে জমা হয়। আর খাগড়াছড়ির যেসব স্থান হতে অবৈধ কাঠ ট্রাকে, পিকআপ ও জীপে এবং কাভারভ্যানে লোড হয় স্থানগুলো হলো মাটিরাঙ্গা, গচ্চাবিল জামতলা, মানিকছড়ি ও তিনটহরী অন্যতম। অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাশ এক বন বিভাগ হতে অন্য বন বিভাগের রেঞ্জার, ডেপুটি রেঞ্জার, ফরেস্টার, বন প্রহরী, বাগান মালি, অফিস সহকারীদেরকে বদলি করে থাকেন। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বদলির ক্ষেত্রে তিনি তাহার অধীনস্থদের মাধ্যমে মোটা অংকের টাকা ঘুষ নেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তাদের পছন্দের বন বিভাগে বদলি করে থাকেন।
অনিয়ম-দুর্নীতি ও কাঠ পাচারের বিষয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাশের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কাঠ পাচার সিএফ করে না। জীবনে কোন দিন দুর্নীতি করেনি, এগুলো ডিএপো’রা কন্ট্রোল করে, আমার রোলস অব বিজনেস আমি জানি, আমাকে কেউ কোন দিন চা খাওয়াতে পারেনি। দুই নম্বরি ৫ নম্বরি সব উত্তর-দক্ষিণ বন বিভাগের ডিএপো’রা করে।
বনের নিয়োগ-পদোন্নতিতে ‘ঘুষের তথ্য’ টিআইবির প্রতিবেদনে :
বন অধিদপ্তরে বন প্রহরী থেকে শুরু করে প্রধান বন সংরক্ষক পদে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি বা পদায়নে ‘লাখ থেকে কোটি টাকা’ ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে।
টিআইবি বলছে, “সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক ও ব্যক্তিগত সহকারী এবং উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একাংশ” এই ঘুষ লেনদেনে জড়িত।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘বন অধিদপ্তর’ সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বন অধিদপ্তরের ‘দুর্নীতি ও অনিয়মের’ ক্ষেত্র উল্লেখ করে ‘বিধিবহির্ভূত’ লেনদেনের চিত্র তুলে ধরেন টিআইবির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. নেওয়াজুল মওলা। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী দাবি করেছেন, তার অধিদপ্তরে নিয়োগ বা বদলির কোনো ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি ‘হয়নি’।
টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে নেওয়াজুল মওলা বলেন, প্রধান বন সংরক্ষক হিসেবে পদোন্নতির জন্য এক কোটি থেকে তিন কোটি টাকা ‘বিধিবহির্ভূত’ লেনদেনের অভিযোগ তারা এ গবেষণা চালাতে গিয়ে পেয়েছেন।
এছাড়া বন সংরক্ষক হিসেবে নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হিসেবে পদোন্নতি বা বদলির ক্ষেত্রে ১০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা, প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেতে এক থেকে দেড় কোটি টাকা এবং সহকারী বন সংরক্ষক পদে বদলির ক্ষেত্রে এক থেকে পাঁচ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়ার কথা জানান তিনি।
টিআইবির প্রতিবেদন বলছে, রেঞ্জ কর্মকর্তা, চেক স্টেশন ইনচার্জ, ফরেস্টার, বিট কর্মকর্তা এবং বন প্রহরী পদে বদলি হতে প্রধান বন সংরক্ষকের দপ্তর, আঞ্চলিক ও বিভাগীয় বন কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একাংশকে ‘লাখ লাখ টাকা ঘুষ’ দিতে হয়।
রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসেবে বদলির ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা, চেক স্টেশন ইনচার্জ ও ফরেস্টার পদে বদলি ১০ থেকে ২৫ লাখ টাকা, বিট কর্মকর্তার বদলিতে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা এবং বনপ্রহরী পদে বদলির ক্ষেত্রে ৫০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকার ‘ঘুষ’ লেনদেন হয় বলে টিআইবির ভাষ্য।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “প্রতিবেদেনে আমরা দেখলাম বন বিভাগে নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলির ক্ষেত্রে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠান জর্জরিত অবস্থায় রয়েছে।”
বনভূমির সুরক্ষা এ অধিদপ্তরের প্রধান দায়িত্ব হলেও তা পালনে তারা ‘সুষ্পষ্ট ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে’ মন্তব্য করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বনভূমির প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার ২৪০ একর জমি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, “বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি বনভূমি জবরখলের ঘটনাও ঘটে, সেগুলো প্রতিরোধে বন অধিদপ্তরকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। অনেক সময় বন অধিদপ্তর এড়িয়ে গেছে। কোনো কোনো বনভূমি জবরদখল ও আত্মসাতের ক্ষেত্রে বন কর্মকর্তাদেও যোজসাজশ রয়েছে।”
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “আমরা বিশেষ করে লক্ষ্য করেছি যে, বন উজার, বনভূমি বেদখল ও অবৈধভাবে বনভূমি বরাদ্দ কিংবা ব্যবহার করতে দেওয়ার ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের একাংশের সম্পৃক্ততা ও যোগসাজশের মাধ্যমে দুর্নীতিকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে রক্ষকই বাস্তবে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে।”
বন অধিদপ্তর ক্ষমতার অপপ্রয়োগও করছে মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, “বনকেন্দ্রিক দুর্নীতি যে হচ্ছে, এই দুর্নীতিতে এক শ্রেণির কর্মকর্তার যোগসাজশ ও তাদের কর্মকান্ড বন সংরক্ষণে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্ত কারণে বন ও বনজ সম্পদের সুরক্ষাকারী হিসেবে বন অধিদপ্তরের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।”
অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে বন অধিদপ্তর ‘ব্যর্থতা দেখিয়েছে’ বলেও মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, “বনভূমি ও এর পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে পরিবেশবিধ্বংসী কয়লা খনি প্রকল্প এবং বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা স্থাপনের বিষয়ে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বন অধিদপ্তর যথাযথ ভূমিকা পালন করতে দেখিনি।”
বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে টিআইবির প্রতিবেদনে। বনভূমি ব্যবহারের আগে অধিদপ্তরের অনুমতি নেওয়া, বন নির্ভর মানুষের ভূমির অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া, সংরক্ষিত বনের জমিতে সামাজিক বনায়ন বন্ধ করা, সামাজিক বনায়নের গাছ না কেটে উপকারভোগীদের মুনাফা দিয়ে বন সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে সেখানে।
এছাড়া বনভূমি নিয়ে সরকারি কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে বন অধিদপ্তরের মতামত নেওয়া বাধ্যতামূলক করা, বনভূমির এলাকায় কোনো স্থাপনা ও বিদ্যুৎ লাইন দেওয়াসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া, বন আইন-১৯২৭ এর সংশোধন ও বিধিমালা প্রণয়ণ এবং প্রয়োজনীয় নতুন আইন করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
টিআইবির পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশনস) শেখ মনজুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে প্রতিবেদনের প্রথম অংশ তুলে ধরেন সংস্থার প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. রেজাউল করিম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এ গবেষণার তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই করা হয়েছে। বন বিভাগের ৬০টি কার্যালয়ের ১৩০ জন মুখ্য তথ্যদাতার সাক্ষাৎকারসহ বিষয়বস্তুর সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত অন্যদের কাছ থেকেও তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করার কথা বলেছে টিআইবি।
Discussion about this post