দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে বন্যাপ্রবণ প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়ছে। সারাদেশে ধেয়ে আসছে বন্যা। ইতিমধ্যে পাঁচ নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে উঠেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে সিলেটে তৃতীয় দফার বন্যায় ফের প্লাবিত হয়েছে জেলার ৯৭ ইউনিয়নের এক হাজার ১৭৬ গ্রাম। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৭ লাখ ১ হাজার ৬৫৮ জন। এছাড়া সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোণা ও শেরপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
মঙ্গলবার (২ জুলাই) বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান স্বাক্ষরিত এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে অতিবৃষ্টি এবং উজানের ঢলে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। দেশের বন্যাপ্রবণ প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে। ইতোমধ্যে পাঁচ নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে উঠে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
এতে আরও বলা হয়েছে, দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল সময় বিশেষে বৃদ্ধি পেয়ে কতিপয় পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সতর্কীকরণ জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি সমতলও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।
আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সমতল বৃদ্ধি পেয়ে কতিপয় পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মুহরী, ফেনী, হালদা, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীসমূহের পানি সমতল সময় বিশেষে বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হতে পারে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানিয়েছেন, সুরমার পানি কানাইঘাট ও সুনামগঞ্জ; কুশিয়ারার পানি অমলশীদ, শেওলা, শেরপুর-সিলেট ও মারকুলিতে; মনু নদীর পানি মৌলভীবাজারে; সোমেশ্বরীর পানি কলমাকান্দায় ও ভুগাইয়ের নাকুগাঁওয়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে পাঁচ জেলার (সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, নেত্রকোণা ও শেরপুর) নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
সিলেটে তৃতীয় দফার বন্যায় ফের প্লাবিত হয়েছে জেলার ৯৭ ইউনিয়নের এক হাজার ১৭৬ গ্রাম। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন ৭ লাখ ১ হাজার ৬৫৮ জন। মঙ্গলবার (২ জুলাই) রাতে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সিলেট জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যায় সিলেটের সবকয়টি উপজেলা আক্রান্ত হয়েছে। বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে সুরমা-কুশিয়ারাসহ সিলেটের বিভিন্ন নদ-নদীর পাঁচটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সবধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা প্রশাসন।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ১১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এই নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে ১০ দশমিক ৭৯ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এখানে বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার।
কুশিয়ারার পানি আমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ৮৯ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ৯৭, শেওলা পয়েন্টে ২৬ সেন্টিমিটার এবং শেরপুরে ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে কিছুটা কমেছে সারি, সারিগোয়াইন ও লোভা নদীর পনি।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বুধবার (৩ জুলাই) পর্যন্ত সিলেটে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, তৃতীয় দফা বন্যার আশঙ্কা আগে থেকেই করা হচ্ছিল। যে কারণে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে দির্দেশনা দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রয়েছে। পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে সরকারের।
প্লাবিত নতুন নতুন এলাকা, দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না
সিলেট অঞ্চলে তৃতীয় দফায় বন্যার আভাস
সিলেট অঞ্চলে দ্বিতীয় দফার বন্যায় সাত লক্ষাধিক মানুষ এখনও পানিবন্দি। মাঝে কিছুদিন পানি কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু গত তিন দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গত সোমবার থেকে নতুন করে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে চারটি উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া বৃষ্টিতে সিলেট নগরীর অনেক স্থানে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। এ অবস্থায় মারাত্মক দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন গ্রামে বেশ কিছুদিন ধরে জলাবদ্ধতার মধ্যে আটকে থাকা মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে আসতে শুরু করেছে সিলেট নগরীতে। তারা শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেছে।
গত সোমবার দিন ও রাতে টানা বৃষ্টি হয়েছে সিলেটে। গতকাল মঙ্গলবার সকালেও বেশ কিছু সময় বৃষ্টি হয়। এ কারণে সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, গোয়াইন, পিয়াইনসহ প্রতিটি নদনদীর পানি বেড়েছে। গতকাল সিলেটের পাঁচ নদীর পানি ছয়টি স্থানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া সকাল পর্যন্ত আগের ২৭ ঘণ্টায় অন্তত ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আগামী তিন দিন সিলেটে ও উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে সিলেটে নতুন করে বন্যা পরিস্থিতি খারাপ হবে বলে ধারণা আবহাওয়া অধিদপ্তরের।
জানা গেছে, নতুন করে গোয়াইনঘাট উপজেলায় প্লাবিত হয়েছে ১৫১টি গ্রাম, হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি। উপজেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নতুন করে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। উপজেলা প্রশাসন জানায়, বর্তমানে প্রায় ২৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা এবং ১৫১টি গ্রাম প্লাবিত। প্রায় ১ হাজার ৫০০ হেক্টর কৃষিজমি নিমজ্জিত। ১৩টি ইউনিয়নে পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ১৯ হাজার ৭৫০টি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৯৮ হাজার ৬০০ জন। এ পর্যন্ত ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে তিনটিতে ৮১টি পরিবার ও ২৯টি গবাদি পশু আশ্রয় নিয়েছে। ইউএনও তৌহিদুল ইসলাম জানান, বন্যা মোকাবিলায় উপজেলা প্রশাসন প্রস্তুত।
উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ওয়ার্ড সদস্য ও স্বেচ্ছাসেবকরা একযোগে কাজ করবেন।
লেঙ্গুড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, এবারের দু’দফা বন্যার পর মনে করেছিলাম, আর বন্যা হবে না। কিন্তু পূর্বাভাসে ফের বন্যার শঙ্কার কথা বলায় গত ২৭ জুন সিলেট নগরীর টিলাগড়ে বাসা ভাড়া নিয়েছি। গত কয়েকদিন স্বজনের বাড়িতে ছিলাম। এভাবে আর ভালো লাগছে না।
ওসমানীনগরেও ২৬২ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে কুশিয়ারা তীরবর্তী সাদিপুর ইউনিয়নের লামা তাজপুর গ্রাম পুরোটাই এখন পানির নিচে। ওই গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। গোয়ালাবাজার সরকারি মহিলা কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক দিলীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, আজ বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে জাতীয় বিশ্বদ্যালয়ের ডিগ্রি পরীক্ষা। আমাদের প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন উপজেলার পরীক্ষাকেন্দ্র। অথচ চারদিকে পানি আর পানি। অনেক এলাকায় বিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ। এ অবস্থায় পরীক্ষায় উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছি।
সুনামগঞ্জেও বন্যা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গতকাল সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে। বেড়েছে সুরমাসহ সব নদীর পানি। সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, আজ বুধবার সকাল থেকে বৃষ্টি হবে, যা ৫ জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এ কারণে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা আছে।
এরই মধ্যে সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় অনেক রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে। শহরের সুরমা নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যার পানি ঢুকেছে। ছাতক উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে আছে। পৌরসভার মণ্ডলীভোগ, ভাজনামহল, কুমনা লেবারপাড়া, তাতিকোনা, চরেরবন্দ, মঙ্গলপাড়া, বৌলাসহ কয়েকটি এলাকায় পানি ঢুকে পড়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ।
নদনদীতে পানি বেড়েছে নেত্রকোনায়ও। কলমাকান্দা উপজেলায় উব্দাখালী নদীর পানি ফের বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া গণেশ্বরী, মহাদেও, বাখলা, মঙ্গেলশ্বরী, বৈঠাখালী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থায় প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চলের বেশ কিছু গ্রামীণ সড়ক। তলিয়ে গেছে প্রায় শতাধিক পুকুর।
পাহাড়ি ঢলের পানিতে শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায় ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেঙে গেছে নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার তিনটি পাহাড়ি নদীর বাঁধ।
এদিকে উত্তরেও বন্যা পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পদ্মাসহ অন্যান্য নদনদীতে পানি বাড়ায় রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় নদী অববাহিকার চরাঞ্চলের নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে বাদামসহ তিলের ক্ষেত। কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ক্ষতি নিরূপণে কাজ করছে তারা।
রাঙামাটিতে শিক্ষার্থী নিখোঁজ
বাঘাইছড়ি উপজেলায় রাস্তা পার হতে গিয়ে বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গিয়ে কৃতিত্ব চাকমা নামে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলের দিকে এ ঘটনা ঘটে। গতকাল বিকেলে বাঘাইছড়ি আবাসিক এলকায় কৃতিত্ব বন্ধুদের সঙ্গে বন্যার পানি দেখতে গিয়েছিল। বাড়ি ফেরার পথে রাস্তা পার হতে গিয়ে পা পিছলে সে স্রোতে ভেসে যায়। গতকাল রাত পর্যন্ত তার সন্ধান মেলেনি। কৃতিত্ব বাঘাইছড়ির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মিল্টন চাকমার ছেলে।
Discussion about this post