নিজস্ব প্রতিবেদকঃ গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মহানগরীর জয়দেবপুর মৌজায় ড্যাপের নকশায় চিহ্নিত জলাশয়ে ১৩তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি প্রদান করার তথ্য-প্রমাণ হাতে পাওয়া গেছে। গেল বছরের (২০২৪ সাল) ২৬ নভেম্বর গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এ অনুমোদন দেয়। ড্যাপের চিহ্নিত জলাশয়ে এই ভূমি ছাড়পত্রের বিষয়ে গুরুতর অনিয়ম হওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট নথিপত্রের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ভূমি ছাড়পত্রটি গাজীপুর সদর উপজেলার জয়দেবপুর মৌজার সিএস-৮৭৫ (অংশ), আরএস-২৪৫৩ (অংশ) খন্দকার নাজিমউদ্দিন গং এর নামে দেয়া হয়েছে। এখানে বড় রকমের জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। এই জালিয়াতি কান্ডের সাথে গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ইমারত পরিদর্শক মুরাদ আলী খান জড়িত বলে জানা যায়।
গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নগর পরিকল্পনা শাখা হতে নগর পরিকল্পনাবিদ কামরুল হাসান সোহাগ স্বাক্ষরিত (স্মারক নং … ১৫০৫.২৪.১৬৮১) ওই ছাড়পত্রে মহানগরীর ২৮নং ওয়ার্ডের বরুদা এলাকায় ৩৬ শতাংশ জমিতে এই ভূমি ছাড়পত্র প্রদান করা হয়। “বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (২০২২-২০৩৫) “গরীবফ টংব তড়হব” হিসেবে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় আবাসিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে, ভূমি ব্যবহার (খধহফ টংব) অ-৫: ঝবৎারপবফ অঢ়ধৎঃসবহঃ এর আলোকে এই ছাড়পত্র প্রদান করা হয়। প্রস্তাবিত জমির পশ্চিমপাশে ৬.১০ মিটার বা ২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা দেখানো হয়েছে; যাতে অ-৫ ক্যাটাগরিতে প্লট ভিত্তিক ভিত্তি ঋঅজ (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) অনুযায়ী ৩.৭৫ দেখিয়ে ১০তলা বা তদূর্ধ্ব সুউচ্চ ভবন নির্মাণের অনুমতি নেওয়া যায়। অথচ তফসিল অনুযায়ী ওই জায়গার সংশ্লিষ্ট তথ্যের সাথে কর্তৃপক্ষের অনুমতি প্রদান করা জায়গার সাথে সরেজমিনে প্রকৃত ভূমির অমিল পাওয়া যায়। জমির আর.এস. দাগ অনুযায়ী এটি ড্যাপের তথ্য মতে, ‘চিহ্নিত জলাশয়’।
সরেজমিনে দেখা যায়, জমির সামনে মাত্র ১০ ফুট রাস্তা বিদ্যমান। এক বছর আগেই ওই জমিতে পাইলিংয়ের করা হয়। এতে বুঝা যায়, জালিয়াতি করে জলাশয়কে আবাসিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ভূমি ছাড়পত্র প্রদান ও ১৩তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি পাইয়ে দেয়ার প্রক্রিয়ায় ইমারত পরিদর্শক মুরাদ আলী খান জোরালো ভূমিকা রাখেন। এক্ষেত্রে দেখা গেছে, জমির পশ্চিমপাশে মূলত ৩.১৬ মিটার বা ১০.৩৬ ফুট রাস্তা এবং ২৮নং ওয়ার্ডে প্লট ভিত্তিক ভিত্তি ঋঅজ ১.৭ নির্ধারণ করা হয়েছে। বিধি মোতাবেক যেখানে অ-৫ ক্যাটাগরিতে কোনভাবেই ওই জমিতে ভবন নির্মাণের অনুমতি পাওয়ার সুযোগ নাই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই অনুমোদন করানোর জন্য ৬০ লক্ষ টাকা ঘুষ আদায় করেন মুরাদ আলী খান।
নগর পরিকল্পনাবিদ কামরুল হাসান সোহাগ বলেন, শতভাগ নিয়ম অনুযায়ী ওই ভূমি ছাড়পত্র প্রদান করেছেন তারা। নিয়মের বাইরে তিনি কিছুই করেননি।
উল্লেখ্য, আধুনিক, কার্যকর, দৃষ্টিনন্দন ও বসবাসযোগ্য মহানগর গড়ে তোলার লক্ষ্যে গৃহায়ন ও গ্ণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঢাকা মহানগর এলাকার জন্য বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান সংক্ষেপে ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) অনুসরণ করে কাজ করে থাকে। ডেপ এর ৩.৫.৩ সেকশনের অনুচ্ছেদ ৭.২.২ অনুযায়ী দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুসারে নদী, খাল, লেক, পুকুর এবং দীঘি জলাশয়ের অন্তর্ভুক্ত। এই আইনে জলাশয় ভরাট, কোন স্থাপনা নির্মাণ, ভবন নির্মাণে অনুমতি প্রদান করা আইনীয় দÐনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
মুরাদ খান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আঞ্চলিক কার্যালয় গাজীপুরের ইমারত পরিদর্শকের দায়িত্ব পান ২০১৫ সালে। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি গাজীপুরে অবস্থান করছেন। এই একদশক সময়ের মধ্যে এখানকার প্রায় সব সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন তিনি। সেই সখ্যতার হাত ধরেই দিনে দিনে বেড়েছে তার প্রভাব ও একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ। একজন সরকারি কর্মচারি হয়েও কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে অনৈতিক উপায়ে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে তিনি পছন্দের ক্লাইন্টদেরকে পাইয়ে দিয়েছেন ইমারত (ভবন) নির্মাণের অনুমতিপত্র।
শুধু নাজিমউদ্দিন গং নয়, ওই জলাশয়ের আশেপাশে নির্মিত বহুতল ভবনগুলোর অধিকাংশই অনুমোদনের কাজ করান ইমারত পরিদর্শক মুরাদ আলী খান। এগুলোর ক্ষেত্রেও একই কায়দায় তথ্য জালিয়াতি করে অনুমোদনের কাজ সম্পন্ন করান মুরাদ আলী খান। এবং অনৈতিক পথে এইসব কাজ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন মুরাদ। বাড়ীয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান শুকুর। তিনিসহ কয়েকজন মিলে গাজীপুর মহানগরীর ২৮নং ওয়ার্ডের মধ্য ছায়াবীথির অভিজাত এলাকায় বেজমেন্টসহ ১০তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি পান রাজউক থেকে আক্তারুজ্জামান শুকুর গং নামে। আক্তারুজ্জামান শুকুর গং এর জমিটি আবাসিক এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হলেও প্রয়োজন অনুযায়ী রাস্তা নাই। এ ক্ষেত্রেও নাজিমউদ্দিন গং এর মত জালিয়াতি করে ২০ ফুট রাস্তা দেখিয়ে বিশেষ প্রকল্পের আওতায় অ-৫: ঝবৎারপবফ অঢ়ধৎঃসবহঃ আলোকে ভূমি ছাড়পত্র ও অনুমতিপত্র আদায়ের কাজ করিয়ে আনেন ইমারত পরিদর্শক মুরাদ আলী খান। নিয়মের তোয়াক্কা না করে এই ভবনটির ভূমি ছাড়পত্র ও ইমারত নির্মাণ অনুমোদনের বিনিময়ে মুরাদ আলী খান হাতিয়ে নেন অন্তত ১৫ লক্ষ টাকা। এই কাজের ভবন ডিজাইনের জন্য ইঞ্জিনিয়ার নেন ২ লক্ষ টাকা অর্থাৎ মোট খরচ হয়েছে ১৭ লক্ষ টাকা। সংশ্লিষ্ট জনদের সাথে কথা বলে জানা যায় এই অনৈতিক লেনদেনের খবর।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলেও ইমারত পরিদর্শক মুরাদ আলী খান কোন বক্তব্য প্রদান করেননি। গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান এর কাছে মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তিনি কয়েক মিনিটের মধ্যে এ বিষয়ে দুইরকম বক্তব্য প্রদান করেন। প্রথমে জানান, “এটা এই অফিস থেকে দেয়া হয়নি। কপি দিন। থানায় মামলা দিয়ে দেব।” এর মাত্র ৫ মিনিট পর তিনি ফের এক ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে বলেন, “না, এটা ঠিকই আছে। জাল নয়। ড্যাপের নিয়ম অনুযায়ী ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে।”সূত্র: দৈনিক মুক্ত সংবাদ
Discussion about this post