চট্টগ্রামের হালদা নদীতে চার দিনের মধ্যে একটি বড় ডলফিন ও চারটি মা মাছের মৃত্যু হয়েছে। প্রায় দেড় বছর পর আবার মা মাছের মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দূষণ বাড়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে নদীতে। এদিকে জুন প্রায় শেষ হলেও এবার হালদার মা মাছ এখনও ডিম ছাড়েনি।
মা মাছের মৃত্যুকে ‘অস্বাভাবিক’ হিসেবে তুলে ধরে এর অনুসন্ধানে তদন্তের দাবিও উঠেছে। মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা বলছেন, সব বিষয় অনুসন্ধান শেষেই এর কারণ জানা যাবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক মনজুরুল কিবরিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হালদা নদীতে দীর্ঘদিন পরে চারটি মা মাছ ও একটি ডলফিনের মৃত্যু অবশ্যই একটি অস্বাভাবিক ঘটনা।
“আরো একটি হতাশাজনক বিষয় হল, জুন মাস প্রায় শেষের দিকে। ইতিমধ্যে হালদায় মা মাছের ডিম পাড়ার জো শেষ। ২০১৬ সালের পর হালদা নদীতে এবছর সবচেয়ে কম ডিম দিয়েছে, যা পরিমাণে নমুনা ডিমের চেয়ে একটু বেশি।”
দক্ষিণ এশিয়ায় কার্প জাতীয় মাছের অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। প্রায় ৯৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি চট্টগ্রামের তিন উপজেলা ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজানের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত।
নদী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, হাটহাজারী অংশে হালদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খালগুলো বেশি দূষণের শিকার। নগরী ও হাটহারাজারী অংশের মধ্যে চলাচলকারী বেশ কিছু খালের দূষণের প্রভাব পড়ছে নদীতে।
হালদা পাড়ের বাসিন্দারা বলছেন, হালদা নদীর সঙ্গে যুক্ত পাঁচটি খাল ও দুটি বিলের পানি শিল্প ও গৃহস্থালী বর্জ্য দূষণে কালো হয়ে গেছে। এসব পানি হালদায় গিয়ে পড়ছে। এতে নদীর পানির পাশাপাশি দূষিত হচ্ছে সংলগ্ন এলাকার কৃষি জমি এবং অন্য পুকুর-জলাশয়ও।
শুক্রবার হাটহাজারী উপজেলার উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের কুমারখালী এলাকায় দুটি কাতল মাছ মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
মৃত মা মাছ দুটির মধ্যে একটি সাড়ে ১২ কেজি ও অন্যটি ১০ কেজি ওজনের। ১০ কেজি ওজনের মা মাছটি পঁচে যাওয়ায় সেটি মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণে সাড়ে ১২ কেজি ওজনের কাতলা মাছটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষণের জন্য নেওয়া হয়েছে।
এর আগে বুধবার রাউজানের উড়কিরচরের বাকর আলী চৌধুরী ঘাট একটি ১০ কেজি ওজনের রুই মাছ মৃত অবস্থায় ভেসে উঠে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির উপস্থিতিতে সেটি মাটি চাপা দেওয়া হয়।
শুধু মাছ নয়, আগের দিন মঙ্গলবার বিকালে হাটহাজারীর গড়দুয়ারা ইউনিয়নের সিপাহির ঘাট এলাকায় নদীতে ভাসমান অবস্থায় ৮৯ কেজি ওজনের ৭ ফুট লম্বা একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়।
মৃত ডলফিনকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও বেসরকারি সংস্থা আইডিএফ এর সহযোগিতায় নদীর পাড়ে আইডিএফ হ্যাচারি এলাকায় মাটি চাপা দেওয়া হয়।
গত সপ্তাহেও উড়কিরচর এলাকায় আরেকটি মা মাছ মৃত অবস্থায় ভেসে উঠলে সেটিও মাটি চাপা দেওয়া হয়।
হঠাৎ করে মা মাছের মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, “কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে। শাখা খালগুলোর দূষণের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় এবং বিষ প্রয়োগে মাছ মারার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া প্রাথমিকভাবে অন্যতম কারণ বলে মনে করি।
“তবে হালদা নদী রক্ষার জন্য বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নাই। এই বিপর্যয় রোধে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দ্রুত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কারণ উদঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।”
হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া মৃত মা মাছটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “উড়কিরচরে উদ্ধার করা একটি মৃত মা মাছের মুখের হা, কানকো ফাঁকা এবং পাখনার অবস্থা দেখে মনে হয়েছে সেটি শ্বাসকষ্টে মারা গেছে।
“আর ডলফিনটি সম্ভবত প্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় মারা গেছে। গত সাড়ে ৫ বছরে এটি মারা যাওয়া ৪১তম ডলফিন। এরআগে সবশেষ ডলফিন মারা গিয়েছিল ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর।”
হাটহাজারীর সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বর্তমানে চা বোর্ডের সচিব মোহাম্মদ রুহুল আমীন নিজের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, “দূষণ ও নদীতে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার এই দুটো বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান প্রয়োজন।
“পাশাপাশি জুন থেকে অগাস্ট এই তিন মাস হালদা নদীর ছিপাতলী অংশে রাতে প্রচুর বড়শি পাতা থাকে। যেগুলো দিয়ে বড় বড় মাছ ধরা হয়। যেসব মাছ বঁড়শির সুতা ছিড়ে বের হয়ে যায়, পরে সেগুলা মারা যায়। এরকম অনেক মাছ অতীতে আমরা পেয়েছি। এ বিষয়টাও দেখা দরকার।”
দূষণই কারণ?
হালদা নদীর সঙ্গে যুক্ত হাটহাজারী ও নগরীর পাঁচটি খালে পড়ে বিভিন্ন কলকারখানা ও গৃহস্থালী বর্জ্য। এসব খালের পানি সরাসারি গিয়ে পড়ে হালদায়।
জুনের শুরু থেকে এসব খালে বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রিত পানি দেখা যাচ্ছে বলে জানান হাটহাজারী মাদার্শা এলাকার বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম মুন্না।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শহরের ট্যানারির বর্জ্য এসে খালে পড়ে। খালের পানি কালো ও তেল মিশ্রিত। দুর্গন্ধে এসব খালের পানি ব্যবহার করা যায় না।”
এরমধ্যে নগরীর চান্দগাঁও অনন্যা আবাসিক এলাকার বামনশাহী খাল, দক্ষিণ মাদার্শা ও শিকারপুর এলাকার কাটাখালী ও কুয়াইশ খাল, বুড়িশ্চর এলাকার খন্দকিয়া খাল ও কৃষ্ণ খাল এবং বাথুয়া খালে দূষণের চিত্র দেখা গেছে।
অধ্যাপক মনজুরুল বলেন, “ট্যানারি ও পোল্ট্রিসহ বিভিন্ন শিল্পের শিল্প বর্জ্য অনন্যা আবাসিক এলাকার বামনশাহী খাল ও কুয়াইশ খাল হয়ে পরে কৃষ্ণ খাল ও খন্দকিয়া খাল বেয়ে হালদায় গিয়ে পড়ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও মৎস্য বিভাগ যৌথভাবে কাজ করতে হবে। কোন কারখানাগুলোর জন্য এ দূষণ তা শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
“কাটাখালী খাল ও কৃষ্ণ খাল হয়ে দূষিত পানি সরাসরি হালদার ব্রিডিং গ্রাউন্ডে গিয়ে পড়ছে।”
হালদা রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে সোচ্চার আমিনুল ইসলাম মুন্না বলেন, “কুয়াইল বিল ও লাল চন্দ্র বিলের পানি এখন পুরোপুরি কালো। এসব বিলে এখন আর কোনো মাছ নেই।
“হালদার সাথে যুক্ত খালগুলোর তীরবর্তী বহু জমি নষ্ট হয়ে গেছে দূষিত খালের পানি ব্যবহার করে চাষাবাদের কারণে। ওসব এলাকার পুকুর-জলাশয়েও এখন আর মাছ নেই। হালদায় আশেপাশের বিল, খাল ও জলাশয় থেকে বর্ষায় মাছ যেত এখন সেই সোর্সগুলোই দূষণে মাছ শূন্য।”
এসব বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২০২২ সালের ২২ নভেম্বরের পর থেকে হালদায় কোনো মা মাছ মারা যায়নি। এখন হঠাৎ করে এতগুলো মা মাছ মারা গেল।
“প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে দূষণটাই মূল কারণ। আগামীকালই আমি হালদা পাড়ে যাব। একটি তদন্ত কমিটি আমরা করব। এনালাইসিস করে তারপর বলা যাবে আসলে কী কারণ।”
শ্রীবাস চন্দ্র বলেন, “নদীতে এখন ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলে না। মা মাছ কোন রোগে আক্রান্ত কিনা সেটাও অনুসন্ধান করা হবে। তবে মনে হচ্ছে দূষণের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে মা মাছের উপর।
“ডলফিনের মৃত্যুর বিষয়টিও ভাবনরা। যেহেতু কাছাকাছি সময়ে মা মাছ ও ডলফিন মারা গেল। তাই সবদিক বিবেচনা করেই তদন্ত করা হবে।”
Discussion about this post