প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর, বিশেষ করে ভারতকে রেল ট্রানজিট দেয়ার বিষয়টিকে বড় ধরনের রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করতে চাইছে বিরোধী বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। এসব দলের নেতারা মনে করছেন সামনের দিনগুলোতে ‘এটিই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু’।
“সরকার এভাবে সব কিছু ভারতের হাতে তুলে দিতে পারে না। আমরা সবার সাথে যোগাযোগ করছি। জনগণকে সাথে নিয়ে আমরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এদিকে রেল ট্রানজিট ইস্যুতে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র সমালোচনা দেখা যাচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে। যদিও আওয়ামী লীগ বলছে এগুলো বিরোধীদের ‘পলিটিক্যাল প্রোপাগান্ডা’, যার সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা নেই।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বিরোধী দলগুলো চেষ্টা করতে পারে কিন্তু তাতে জনগণের সমর্থন থাকবে না বলে তিনি মনে করেন। তার মতে ভারতের সাথে ‘কানেক্টিভিটির কারণে’ মানুষ উপকৃত হচ্ছে বলে রাজনীতির মাঠে ‘ভারত ইস্যু’র এখন আর কোন গুরুত্বই নেই।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে সম্প্রতি যে দশটি সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে, সেগুলোর একটি হচ্ছে রেল ট্রানজিট।
এর আগে মোংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্যের ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের জোরালো দাবি পূরণ করেছিলো বাংলাদেশ। এগুলোর বিনিময়ে বাংলাদেশ কতটা অর্থ আয় করছে তা নিয়েও বড় প্রশ্ন আছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার অবশ্য সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভারতকে রেল ট্রানজিট দেয়ার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের কোনও ক্ষতি হবে না।
বিরোধী দলগুলো কী করতে চায়
ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করে রেলযোগে দেশের এক অংশ থেকে আরেক অংশে সরাসরি নিজেদের পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে ভারত, যা দীর্ঘদিন ধরেই দেশটি চেয়ে আসছিলো বলে প্রচার আছে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতাদের সাথে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো- তারা মনে করেন ভারতকে রেল ট্রানজিট দেয়ার খবরে সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তীব্র সমালোচনার প্রেক্ষাপটে এটিই আগামী দিনের বড় রাজনৈতিক ইস্যু হবে বলে তাদের ধারণা।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভাতেও বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ভারত এ যাবতকাল ধরে যা যা চাইছিলো তার সবই এ সরকার দিয়ে দিয়েছে। দরকষাকষির জন্য যে দু একটি টুলস হাতে রাখতে হয় সেটি পর্যন্ত রাখেনি।
“অথচ এ সবের বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। বরং পানি ও সীমান্ত হত্যার মতো বিষয়গুলো আলোচনাতেই নেই। দেশের প্রতিটি মানুষ ক্ষুব্ধ। আমরা সব দলের সঙ্গে কথা বলছি। এর বিরুদ্ধে জনগণকে নিয়ে সোচ্চার হবো,” তিনি বলেন।
এর আগে মঙ্গলবারই এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছিলেন যে শুক্রবার এ বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্য তারা তুলে ধরবেন। ধারণা করা হচ্ছে সেখান থেকেই এ বিষয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচির ঘোষণা দিতে পারে দলটি।
এর আগে বিএনপির সমমনা দলগুলো ভারতীয় পণ্য বয়কটের যে কর্মসূচি দিয়েছিলো তাতেও দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব আনুষ্ঠানিকভাবে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো।
দলটি অবশ্য পরে একাধিকবার বলেছে তাদের কর্মসূচি বা বক্তব্য বাংলাদেশের শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে, ভারতের বিরুদ্ধে নয়। দলটির নেতারা বলেছেন বরং তারা চান ভারত বাংলাদেশের কোন বিশেষ দল নয়, বরং ‘জনগণের সাথে সম্পর্ক’ দৃঢ় করুক।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, চলতি বছরের জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ আছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর। তারা মনে করেন ‘ভারতের ভূমিকার কারণে’ই বিরোধী দলগুলোর বর্জন সত্ত্বেও নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার।
এখন রেল ট্রানজিট ইস্যুতেও বিএনপি ও সমমনা দলগুলোও তীব্র সমালোচনা করছে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে, তিনি মনে করেন এটিই হবে আগামী দিনের বড় রাজনৈতিক ইস্যু এবং এর বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে।
“পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা সব ভুলিয়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী খালি হাতে ফিরেছেন। রেল ট্রানজিট ইস্যুকে ঠিকমতো ব্যবহার না করে একতরফা ছেড়ে দিয়েছে সরকার। এটি কেউ মানবে না,” বলছিলেন মি. হক।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম দলের এক সমাবেশে বলেছেন, সরকার ভারতের সাথে গোলামি চুক্তি করেছে, যেখানে বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিছুই নেই।
“তিস্তার কথা নেই। পানির কথা নেই। সীমান্ত হত্যা নিয়ে চুক্তি নেই। চুক্তি হয়েছে বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে ট্রেন ভারতে যাবে। নৌ বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দিতে হবে। এ চুক্তি বাস্তবায়ন করতে দেয়া হবে না,” তিনি ঘোষণা করেন।
জামায়াতে ইসলামীও এক বিবৃতিতে ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকগুলোর তীব্র সমালোচনা করে বলেছে, আওয়ামী লীগ প্রতিবারই প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করে ভারতের হস্তক্ষেপে বারবার ক্ষমতায় আসে। “ফলে জনসমর্থনহীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বরাবরই ভারতকে তুষ্ট করতে হয়”।
দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ চায় জাতীয় পার্টি
তবে রেল ট্রানজিটসহ প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে যেসব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন যে, চুক্তিতে কি আছে বিস্তারিত কেউ তা জানে না এবং সরকারও তা প্রকাশ করেনি।
“আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই যে কোন দেশের সঙ্গে চুক্তি হতে হবে পারস্পারিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, যাতে উভয় পক্ষ সমানে সমানে লাভবান হতে পারে”।
তিনি বলেন, ছাড় দিয়ে বাংলাদেশ কী পাচ্ছে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে কোন বিষয় কতটুকু ছাড় দেয়া হবে এবং তারা বিনিময়ে কী দিচ্ছে তার সব হতে হবে সমানে সমান।
“এখন এ চুক্তি বা সমঝোতায় কী আছে বা কীভাবে কি হবে সে সম্পর্কে জনগণকে কিছুই জানানো হয়নি। সুনির্দিষ্টভাবে না জেনে রেল চুক্তি বা ভারতের সাথে যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে সেগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করা যৌক্তিক হবে না। আমরা শুধু চাইবো চুক্তি বা সমঝোতা যাই হোক- তাতে দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হতে হবে এবং উভয় দেশ যেন লাভবান হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে,” বলছিলেন মি. কাদের।
জনগণের সমর্থন পাবে না বিরোধীরা: আওয়ামী লীগ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি দেশকে বিক্রি করেন না।
“আমি সব সময় দেশের স্বার্থ রক্ষা করে চলি। শেখ হাসিনা এ দেশকে বিক্রি করে না। কারণ আমরা এ দেশ স্বাধীন করেছি,” বলেছেন তিনি।
তিনি বলেন, “যত ছোট হোক, এটা আমাদের সার্বভৌম দেশ। সেই সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও স্বকীয়তা বজায় রেখে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে কাজ করছি”।
দেশের মানুষের কল্যাণের কথা মাথায় রেখেই ভারতের সঙ্গে রেল যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু এরপরেও বিষয়টি বড় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠতে যাচ্ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, বিরোধী দলগুলো যে কোন ইস্যু নিয়েই এগুতে পারে কিন্তু সেটাতে জনগণের সমর্থন তো পেতে হবে।
“যেটার সাথে মানুষের কোন সম্পর্ক নেই সেই আন্দোলনে মানুষ যাবে কেন? এখানে ভালো কিছু হতে দেখলেই এক শ্রেণির লোক সমালোচনা করে। এটা তাদের রাজনীতি। এগুলোর মূল্য জনগণের কাছে নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, রেল ট্রানজিটের বিষয় রাজনৈতিক ময়দানে বড় কোন ইস্যু হয়ে উঠবে কি না, সেটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, ভারতের সাথে হওয়া চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক নিয়ে ইস্যুতে যা হচ্ছে সেটা হলো রাজনৈতিক বাহাস এবং তিনি মনে করেন এটি তখনই ইস্যু হবে যখন সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করবে।
“দেখার বিষয় হবে বিরোধী দল গুলো সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে কি-না। সেটি না করতে পারলে সরকারের জন্য খুব একটা চিন্তার কারণ হবে বলে মনে হয় না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
Discussion about this post