স্টাফ রিপোর্টার :: গাজীপুর শিল্পঅধ্যুষিত এলাকায় ৪০ লাখ মানুষের একমাত্র সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্র শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালটি চালুর পর থেকেই বিভিন্ন অনিয়ম ও ঘূষ-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এবার হাসপাতালের আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের কাজ দেওয়া হওয়ছে এক চিকিৎসকের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে। ওই প্রতিষ্ঠান লোক নিয়োগের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। তখন মিয়া এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ইলেকট্রেশিয়ান ২ জন, মালি ২ জন, কুক ৬ জন ও অনন্য পদে ৯৫ জনসহ ১০৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই সময়ে চাকরি পাওয়ার জন্য তাদের প্রত্যেককেই কমবেশি ঘুষ দিতে হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানকে। এক বছরের চুক্তি থাকলেও প্রতিষ্ঠানকি হাসপাতালে ব্যবস্থা করেছেন প্রায় ৮ বছর। ওই সময় ইলেকট্রেশিয়ানদের বেতন ধরা হয় ১৮ হাজার ১২০ টাকা, মালি ও কুকদের ১৬ হাজার ৯২০ টাকা ও অনন্য পদে বেতন ছিল ১৬ হাজার ৬২০ টাকা। কাগজে কলমে সেই বেতন ধরা হলেও বাস্তবে প্রথম দিকে বেতন দেওয়া হতো ৬ হাজার টাকা করে। এরপর বাড়িয়ে দেয়া হতো ৮ হাজার এবং সর্বশেষ ১০ হাজার টাকা।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তাদের বেতন দেয়া হয়েছে ১৫ হাজার টাকা করে। গত প্রায় ৮ বছর কর্মীদের বেতন উঠানোর অ্যাকাউন্টের হিসাব বইয়ে স্বাক্ষর নিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আটকিয়ে রাখতেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতনের টাকা উঠিয়ে তাদের দেয়া হতো কম টাকা।
আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কর্মী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, বেতন যেটা নির্ধারন করা হয়েছিল তার চেয়ে কম দিবে সেটি জেনেই চাকরি নিয়েছি। কারণ বেতন কম দেয়া হলেও হাসপাতালে চাকরি করলে নানা ভাবে আয় করার সুযোগ রয়েছে।
হাসপাতালের আউটসোর্সিং কর্মীরা জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠনের অনিয়মের বিষয়ে কথা বলার কেউ নেই। যেহেতু হাসপাতালে কাজ করলে কিছু অতিরিক্ত আয় করা যায় যেটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও জানে। যার কারনে কর্মী নিয়োগের সময় আলাদা করে কম বেতন দেওয়া হবে মর্মে একটি করে চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নেয়। চাকরির লোভে কর্মীরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বাক্ষর করেন। তাদের চেকবই কখনোই দেওয়া হতো না। তবে ৫ আগস্টের পর তারা চেকবই পেয়েছে। চেক বই পেলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। কারণ নতুন করে আবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। নিয়োগ কমিটিতে যারা আছেন তারা নিয়ম বিহর্ভুত ভাবে ‘বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমেটডের’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে কর্মী নিয়োগের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি কর্মী নিয়োগের নামের পুরাতন কর্মীদের কাছ থেকে এক লাখ টাকা এবং নতুনদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে দেড় থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত। তাতে ৮০ থেকে প্রায় কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এনিয়ে বিভিন্ন সমাজিক যোগাযোগ মধ্যমে সমালোচনাও হেয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক আমিনুল ইসলাম ওরফে সুলতান। কাগজে কলেমে তিনি মালিক থাকলেও কর্মী নিয়োগের দায়িত্ব পালন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করছেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সার্জারী বিভাগের প্রধান খলিলুর রহমানের বিদেশ ফেরত ছোট ভাই খাইরুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ে রাজধানীর উত্তরায় হলেও গাজীপুর শাখা অফিস দেখানো হয়েছে মহানগরীর ভোড়া এলাকায়।
এছাড়া গাজীপুর জেলা শহরে সার্জারী বিভাগের প্রধান খলিলুর রহমানের ‘কেয়ার এন্ড কিউর হাসাপাতাল নামে একটি প্রাইভেট হাসপাতাল রয়েছে গাজীপুর জেলা শহরের প্রকৌশলী ভবনে। সেটি দেখাশুনা তিনিসহ তার পরিবার সদস্যরাই করে থাকেন। ওই প্রতিষ্ঠানেই আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগের ফর্ম ছাড়া হয় এবং জমা নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সার্জারী বিভাগের প্রধান খলিলুর রহমান জানান, ওই হাসপাতালটি তার নয় সেখানে তার চেম্বার রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তার বা তার ছোট ভাইয়ের কোনো যোগসূত্র নেই বলেও দাবি করেন।
ওই চিকিৎসকের ছোট ভাই খাইরুল ইসলাম বলেন, কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার বন্ধু-বন্ধব জড়িত আছে তারা আমাকে ইনভাইট করছিল ভাই আপনি এটা দেখোশুনা করেন। কিন্তু এর সঙ্গে আমার মা আমার ভাইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক আমিনুল ইসলাম ওরফে সুলতান বলেন, কাজ পাওয়ার পর শুরুতে আমরা কেয়ার এন্ড কিউর হাসপাতালে কিছু কাজ করেছিলাম। এখন সেখান থেকে অফিস তুলে দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কর্মী নিয়োগের জন্য কোনো টাকা পয়সা আমরা নেয়নি। সবলোক দিয়েছে স্থানীয় জামায়াত ও বিএনপির নেতারা। তারা কি করেছে সেটি আমার জানা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৪ অক্টোবর স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় হাসপাতালের একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০৫ জন আউটসোর্সিং কর্মচারী নেওয়া হবে। এর জন্য প্রকৃত ঠিকাদার বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে দরপত্র আহ্বান করা যাচ্ছে। ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ৫৫ টি টেন্ডার জমা পড়ে। সেই টেন্ডার হাসপাতালের জনবল নিয়োগের টেন্ডার কমিটি বিএস এস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমেটড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়। দরপত্র আহ্বান ও টেন্ডার যাচাই বাছাই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন সার্জারী বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ খলিলুর রহমান। কাজ পাওয়া ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিক অন্যজন হলেও সেটি পরিচালনা করছে ওই চিকিৎসেকের ছোট ভাই খাইরুল ইসলাম। এছাড়া জেলা শহরে খলিলুর রহমানের মায়ের নামে কেয়ার এন্ড কিউর জেনারেল ও স্পেশালাইসড নামের একটি হাসপাতাল রয়েছে। সেই হাসপাতালে বসেই কর্মী নিয়োগের কাযক্রম শুরু করেন। সেখানে বসেই কর্মী নিয়োগের নামে জন প্রতি নেয়া হয় এক থেকে আড়াই লাখ টাকা পযন্ত।
নিয়োগ পাওয়া এক কর্মী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, হাসপাতালে চাকরি পাওয়া গেলে নানা ভাবে টাকা আয় করা যায়। তার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছি। অস্থায়ী নিয়োগ হলেও দীর্ঘদিন কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়। আমার মতো আরো অনেকেই টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছে। নতুন কর্মী নিয়োগের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমেটড নামের প্রতিষ্ঠানটির মালিক আমিনুল ইসলাম ওরফে পারভেজ। তার অফিসের ঠিকানা দেয়া হয়েছে রাজধানীর উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়ি। ঠিকানা অনুযায়ী ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, লিফটের ৮ তলায় একটি কক্ষের দরজায় কম্পিউটারে প্রিন্ট করা একটি কাগজে লেখা রয়েছে প্রতিষ্ঠানের নাম। তবে ওই অফিসে কাউকে পাওয়া যায়নি। ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মী জানায়, পারভেজ নামের এক ব্যাক্তি ওই কক্ষটি ভাড়া নিয়েছেন। সপ্তাহে এক বা দুইবার তিনি এখানে আসেন।
এছাড়া ওই প্রতিষ্ঠানের গাজীপুর শাখা অফিস দেখানো হয়েছে মহানগরীর ভোড়া এলাকায়। হাসপাতালে আগে থেকে কর্মরত ১০৫ জনের মধ্যে ১৭ জনের চাকরি বহাল রাখা হয়েছে। এজন্য প্রত্যেকের থেকে নেওয়া হয়েছে চাহিদা অনুযায়ী অর্থ। পরিচয় না দেওয়া শর্তে পুরাতন কয়েকজন বলেন, তাদের চাহিদামতো যারা টাকা দিয়েছে, তাদের চাকরিতে রাখা হয়েছে। অনেকের টাকা দেয়ার সামর্থ নেই, এজন্য তারা টিকেনি। হাসপাতালের পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, আমার জানা মতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগে কোনো অনিয়ম হয়নি। সরকারি চাকরি করে হাসপাতালের কোনো চিকিৎসক বা তার স্বজনদের এর সঙ্গে জড়িত হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।
Discussion about this post