পুলিশে জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা শতভাগ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন পুলিশের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা। তারা বলেন, পুলিশের মধ্যে দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু তার প্রভাব পড়ছে দুই লাখ ৭০ হাজার সদস্যের পুলিশ বাহিনীর উপর। দুর্নীতি নির্মুল করতে হলে পদোন্নতি হতে হবে নিয়ম অনুযায়ী যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা, অভিজ্ঞতা ও সততা ভিত্তিতে। কিন্তু এসবের ভিত্তিতে পদোন্নতি ও বদলি হচ্ছে না। এক্ষেত্রে দলবাজদের জয় জয়কার। এটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কিন্তু এটা শুধু বর্তমান সরকারের আমলে নয়, বিগত সরকারের আমল থেকেও চলে আসছে। পদোন্নতি ও বদলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের অর্থ ও অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান ছাড়া হয় না। বর্তমানে এটা একটা বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে।
পুলিশের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, একজন পুলিশ দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করবে। মামলার সঠিক তদন্ত করবে। কিন্তু এটা না করে বসের খুশি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এক শ্রেণীর পুলিশ। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবর সাহেব শেভ করতেন একটি সেলুনে। ওই সময় একজন পুলিশের একজন ডিসি সেলুনে গিয়ে আগেভাগে তাওয়াল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ওই ডিসি একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় জড়িত ছিলেন। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় জজ মিয়া নাটক যারা সাজিয়েছিলেন, সেসব পুলিশেরও পদোন্নতি পেয়েছেন। এই ধরনের পুলিশ আমরা চাই না। কেউ ভুলে যাবেন না, আমরা আপনাদের পরিবারের সন্তান। আপনাদের সেবা ও নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। এটাই হচ্ছে আমাদের মূলমন্ত্র। তাই কতিপয় দুর্নীতিবাজদের জন্য সমগ্র পুলিশ বাহিনকে ঢালাওভাবে দায়ী করলে, এটা হবে বড় অন্যায়। আমরা দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করি, ধিক্কার জানাই। শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাসা বাড়িতে বাজার করে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন এক শ্রেণীর পুলিশ। নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে তদ্বির করতে তারা ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। যার কারণে পরিস্থিতি এমন হয়েছে, যেন গ্রামাঞ্চলের থানা চালায় পুলিশ না, চালায় দলবাজরা। এটা তো হওয়ার কথা না। ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধি সম্প্রতিকালে পুলিশের দুর্নীতি নিয়ে ডিআইজি, এসপি, ইনস্টপেক্টরসহ অর্ধশতাধিক পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছেন। কেউ কথা বলতে বলতে কেদেই ফেলেন।
তারা বলেন, আমরা দুর্নীতি সমর্থন করি না। শুধু কি পুলিশই দুর্নীতি করে? সচিবালয় থেকে ব্যাংকপাড়া সর্বত্র দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারের কাছে আবেদন, দুর্নীতিবাজদের নির্মূল করুন, তাদের ধিক্কার জানান। আর পুলিশের পদোন্নতি হবে যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও সততার ভিত্তিতে-এই বিষয়টি নিশ্চিত করুন। কিন্তু বর্তমানে চলছে উল্টো পথে। যে বেশি দুর্নীতিবাজ তাকে ভালো জায়গায় পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। তার পদোন্নতির ফাইলও দ্রুত অনুমোদন হয়ে যায়। কারণ সে টাকাসহ বিভিন্ন অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিতে পারেন। তাদের সংখ্যাও সীমিত। যারা দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন। কনস্টবল থেকে আইজি পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে স্তরে দেখভাল করার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি স্তরেই দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করারও ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু তারপরও দুর্নীতি হচ্ছে কেন? দলবাজরা করে দুর্নীতি। যারা পেশাদার পুলিশ তারা তো দুর্নীতি করেন না। তারা উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তারা হয়ে যান রাজাকারের সন্তান। দলবাজদের বেশিরভাগ সরকারবিরোধী ও রাজাকার-আলবদলের পরিবারের সন্তান।
পুলিশের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আমরা সেই পুলিশ। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রান্ত হয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের মোকাবেলা করেছি। জীবন দিয়েছি। করোনার সময় কেউ কারোর সন্তান কবর দেয় না, করোনা আক্রান্ত মাকে রাস্তায় ফেলিয়ে দিয়েছে। আমরা অসুস্থদের ওষুধ দিয়েছি। মৃতদের কবর দিয়েছি। ঝড়-বৃষ্টির মাঝেও দায়িত্ব পালন করে আসছি। এতো কিছু করেও কেন আমরা দুর্নীতির বোঝা মাথায় নিবো? পুলিশ সদস্যদের যানবাহনসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাও নেই। সচিবালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা সব সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন, তারা বিভিন্ন প্রকল্পে এক কলমের খোঁচায় হাজার কোটি টাকা নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। এটা যেন দেখার কেউ নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। পুলিশের জন্য তিনি অনেক কিছু করেছেন। দলবাজ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীর লোক না। বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ডিআইজি নারী কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ছিলেন। পুলিশ সদর দপ্তর এটা গোপন রেখে তাকে পদোন্নতি দিয়ে ডিআইজি বানিয়েছে। কয়েক জন এসপির বিরুদ্ধেও নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। এদেরকে যারা পদোন্নতি দিচ্ছে তারা শীর্ষ দুর্নীতিবাজ। সৎ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ সদস্যরা শীর্ষ দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানিয়ে বলেন, প্রয়োজনে দেশের জন্য জীবন দিতে রাজি আছি। সচিবালয়ের কর্মকর্তারা যে সুযোগ-সুবিধা পায়, তাদের চেয়ে চার গুণ কম সুযোগ-সুবিধা পেয়েও আমরা সর্বোচ্চ সেবা দিচ্ছি এবং দিয়ে যাব। যারা সত্যিকার দুর্নীতিবাজ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পুলিশ কর্মকর্তারা আহ্বান জানান। বর্তমান বাজার মূল্যের সঙ্গে সমন্বয়ক করে পুলিশের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার দাবি জানান তারা।
সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, পুলিশে আগেও তদ্বির ছিল, কিন্তু সেটা ছিল খুব কম। সিনিয়র, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সততার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া হতো। এখন যাদের পদোন্নতি হয়, তাদের বেশিরভাগ কাজ করে না, দলবাজ করে। দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্যদের যেন জয় জয়কার। তারা পদোন্নতি পাচ্ছে। এই জিনিসটা খুবই ভয়ঙ্কর। অবশ্যই এটা বন্ধ করতে হবে। সিনিয়র, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সততার ভিত্তিতে পদোন্নতি দিতে হবে। যারা ভালো কাজ করে তাদের পুরস্কার এবং যারা দুর্নীতিতে জড়িত তাদের তিরস্কার করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশের কোনো কোনো সদস্যের পেশাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠার পরিস্থিতি বা সুযোগ পুলিশের কর্মকাণ্ডকে সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। পুলিশের কর্মকাণ্ড একটি নির্দিষ্ট কাঠামো অনুসারে পরিচালিত হলেও দুর্নীতিপরায়ণ সদস্যদের প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা এবং প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা দুর্নীতির মাত্রা ও সংখ্যা লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি করছে। পুলিশের মধ্যে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি, জনগণের নিকট দায়বদ্ধতার প্রতিশ্রুতি পূরণে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বমূলক ভূমিকা পালনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে পুলিশের মধ্যে দুর্নীতি পরায়ণ সদস্যরা কোণঠাসা হয়ে পড়বে এবং এর ফলে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা অনেকটাই সহজ হবে।
Discussion about this post