নিজস্ব প্রতিবেদক :: কখনো খুব একটা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছিল না। মুসলমানের ছেলের হিন্দু মাস্টার, কতো বড় বড় মুসলমানের কায়কারবারে হিন্দু প্রধান। জন্ম আমার মুসলিম পরিবারে। কিন্তু গুরু আমার নিম্ন বর্ণের হিন্দু দুঃখীরাম রাজবংশী। তাই এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চাইতে বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতকেই ভাবতে হবে, বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। যদিও এখনকার অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই ভালো করে চিনি না, জানি না। আমাদের সময়ের অনেকেই চলে গেছেন, অবসরে গেছেন। তবু দীর্ঘ সময় ভারতে থেকে ভারতের যে প্রাণ খুঁজে পেয়েছি তাতে এক সময় সত্যিকার অর্থেই দু’দেশের সম্পর্ক হবে দেশের জনগণের উপর ভিত্তি করে, কোনো ব্যক্তি বা দলের উপর নয়।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের আরাধ্য স্বাধীনতার মাস ডিসেম্বর। প্রবল পরাক্রমশালী পৃথিবীর এক দারুণ শক্তিশালী বাহিনীকে পরাজিত করে আমরা স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলাম। ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়লে আমরা যেমন দিশাহারা অসহায় হয়ে পড়েছিলাম, ’৭১- এর ডিসেম্বরের দিকে পাকিস্তানি হানাদাররা তেমন দিশাহারা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিল। ৬ই ডিসেম্বর ভুটান এবং ভারত আমাদের স্বীকৃতি দেয়। মহান ভারত বিরাট দেশ। তাদের স্বীকৃতি নিয়েই আলোচনা হয় বেশি। কিন্তু সবার আগে ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছিল। যদিও সেই ভারত নিয়ে, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক নিয়ে ইদানীং বড় টানাটানি। কোনোক্রমেই এমনটা হওয়া উচিত ছিল না। রাজনৈতিক সখ্যতা বা দূরত্ব অনেক কিছুই থাকবে। কিন্তু তাই বলে এক দেশ আরেক দেশের সঙ্গে চরম শত্রুতা করবো, মর্যাদাহানি করবো- এটা হতে পারে না। কিন্তু আদতে তাই হচ্ছে। সুপরিকল্পিতভাবে অনেক জায়গায় স্কুল- কলেজের সামনে ভারতীয় পতাকার অবমাননা করা হচ্ছে। আবার এদিক থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধুয়ো তুলে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। সত্যিকার অর্থেই আমরা হাজার বছর একসঙ্গে বাস করছি- কখনো খুব একটা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছিল না। মুসলমানের ছেলের হিন্দু মাস্টার, কতো বড় বড় মুসলমানের কায়কারবারে হিন্দু প্রধান। জন্ম আমার মুসলিম পরিবারে। কিন্তু গুরু আমার নিম্ন বর্ণের হিন্দু দুঃখীরাম রাজবংশী। তাই এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চাইতে বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতকেই ভাবতে হবে, বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। যদিও এখনকার অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই ভালো করে চিনি না, জানি না। আমাদের সময়ের অনেকেই চলে গেছেন, অবসরে গেছেন। তবু দীর্ঘ সময় ভারতে থেকে ভারতের যে প্রাণ খুঁজে পেয়েছি তাতে এক সময় সত্যিকার অর্থেই দু’দেশের সম্পর্ক হবে দেশের জনগণের উপর ভিত্তি করে, কোনো ব্যক্তি বা দলের উপর নয়।
মুক্তিযুদ্ধের কথা বলছিলাম। ৬ই ডিসেম্বর নিকরাইলে কাদেরিয়া বাহিনীর উদ্যোগে এক বিশাল সভা হয়েছিল। যুদ্ধের মধ্যে ওরকম বিশাল ‘সভা’ একমাত্র সখিপুরের কচুয়ায় ৫ই আগস্ট হয়েছিল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকায় এমনিই টেকা যায় না, তার উপর সমাবেশ করা সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। যেকোনো মুহূর্তে বিমান বাহিনী বোমা ফেলে তছনছ করে দিতে পারে। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে ৫ই আগস্ট সখিপুরের কচুয়ায় এবং ৬ই ডিসেম্বর কালিহাতীর নিকরাইলে কোনো আক্রমণ হয়নি। আকাশ পথে আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও জমিনে কিছুই করার সম্ভাবনা ছিল না। ডিসেম্বরের ১-২ তারিখ ভারত থেকে ক্যাপ্টেন পিটার নামে একজন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা এসেছিলেন। আমার এখনো মনে হয় তার নাম পিটার নয়, সেটা ছিল ছদ্মনাম। আর তিনি ক্যাপ্টেনও ছিলেন না, তিনি ছিলেন মেজর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশের অত গভীরে আর কোনো ভারতীয় কর্মকর্তা আসেনি। তিনি দু’টি মহান দায়িত্ব নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন। তার একটি কাদেরিয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন কোথাও নিরাপদে ছত্রীসেনা নামানো, অন্যটি যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে এয়ার সাপোর্ট দেয়া। ক্যাপ্টেন পিটার অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাংলাদেশের একমাত্র টাঙ্গাইলের পুংলী, চিনামুড়া, চমুড়া, সহদেবপুর, বানিরায় সফলভাবে ছত্রীসেনা নামানো হয়েছিল। মনে হয় পৃথিবীর ইতিহাসে অত নিরাপদে আর কোথাও ছত্রীসেনা অবতরণ করেনি। ১০ই ডিসেম্বর আমরা কালিদাসপাড়া সেতু দখল করে বানিয়াপাড়া সেতুতে আক্রমণ করেছিলাম এবং দুটো সেতুই ভেঙে দিয়েছিলাম। ঘাটাইল থানা আক্রমণ করা হয়েছিল ভোর ৪টার দিকে। ৬-৭টার মধ্যেই থানা মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। থানার মূল টিনের ঘর কমান্ডার আব্দুল হাকিম, বীরপ্রতিকের ছোড়া থ্রি ইঞ্চ মর্টারের গোলায় তছনছ হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে হানাদাররা থানা ছেড়ে পালিয়ে ছিল। অন্যদিকে থানা দখল করে মেজর হাবিব, বীরবিক্রম তার কোম্পানি নিয়ে মধুপুরের দিকে এগিয়ে বানিয়াপাড়া সেতুর উত্তর অংশ ভেঙে দিয়ে অবস্থান নিয়েছিল। ঘাটাইল থানা মুক্ত হওয়ার পর গোপালপুরের উপর আক্রমণের গতি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু গোপালপুর থানা দখল করা যাচ্ছিল না। তাই আমরা এয়ার সাপোর্ট চেয়েছিলাম। সেই প্রথম মিত্র বাহিনীর কাদেরিয়া বাহিনীকে এয়ার সাপোর্ট দেয়া। বেলা দুই-আড়াইটার দিকে এমন নিখুঁত নিশানায় গোপালপুরে মিত্রবাহিনী বিমান হামলা করে যেটা অতুলনীয়। অন্যদিকে ময়মনসিংহ এবং জামালপুর থেকে পালিয়ে আসা হানাদাররা বানিয়াপাড়া সেতুতে বাধা পায়। পাকিস্তান হানাদাররা পাগলপারা হয়ে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে রাস্তা মুক্ত করার জন্য আঘাত হানে। ময়মনসিংহ এবং জামালপুর থেকে প্রায় দুই ব্রিগেড মনোবলহারা সৈন্য ঢাকার দিকে পিছিয়ে যাচ্ছিল। অত বড় একটা বাহিনীকে খুব ভালো প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি না করলে বা না করতে পারলে থামিয়ে রাখা যায় না। আমাদের উদ্দেশ্য অত বড় বাহিনীকে আটকে দেয়া ছিল না, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল শত্রুকে পদে পদে বাধা দেয়া। মেজর হাবিব, বীরবিক্রম তার প্রতিরক্ষা তুলে নিলে পাকিস্তান হানাদাররা ভাঙা বানিয়াপাড়া সেতুতে কিছুটা মাটি ফেলে ঠিকঠাক করে পালিয়ে যাবার রাস্তা প্রশস্ত করে। এক্ষেত্রে আমাদের ছোট্ট একটা ভুল হানাদারদের কিছুটা সাহায্য করেছিল। আমাদের ভুলটা ছিল বানিয়াপাড়া সেতুর পাশে হাজার-বারো’শ মণ পাট ছিল। আমরা জ্বালিয়ে দিলে অথবা সরিয়ে ফেললে হানাদারদের পিছিয়ে যেতে আরও অনেক সময় লাগতো। সেতুর পাশে অত বিপুল পরিমাণ পাট থাকায় সেগুলো নিচে ফেলে তার উপর মাটি দিয়ে হানাদাররা সেদিন পিছিয়ে গিয়েছিল।
৩রা এপ্রিল ’৭১ সন্ধ্যার দিকে টাঙ্গাইলে হানাদার বাহিনী ঢুকেছিল। ২০শে এপ্রিলের পর তারা দারুণ প্রতাপে রাস্তার দুইপাশে কামান-বন্দুক চালিয়ে ঘর-দুয়ার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মধুপুর হয়ে ময়মনসিংহ, মধুপুর হয়ে জামালপুর। সেখান থেকে সীমান্তে গিয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদারদের জন্য ডিসেম্বরে ঢাকা ফেরা ছিল দারুণ বিপদের। অসহায় বাঙালি রিফিউজিরা যতটা কষ্ট করে সীমান্তে গিয়েছিল, তার চাইতে অনেক বেশি অসহায়ের মতো পাকিস্তান হানাদাররা লেজ গুটিয়ে ঢাকার পথে ফিরছিল। এতকিছুর পরও তাদের অনেকেরই সেদিন প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারেনি। তারা কেউ কেউ ধরা পড়েছে, কেউ কেউ রাস্তায় রাস্তায় জীবন দিয়েছে। ১০ই ডিসেম্বর সকাল থেকেই যুদ্ধ পরিস্থিতি ছিল আমাদের অনুকূলে। সকালে আমরা ঘাটাইল থানা দখল করে নিলেও দুপুরে ময়মনসিংহ-জামালপুর থেকে পিছিয়ে আসা হানাদার বাহিনীর হাতে চলে গিয়েছিল। কারণ ঘাটাইল থানা একেবারে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ রাস্তার গা-ঘেঁষে। তাই তখন আর আমাদের থানা দখল রাখা সম্ভব ছিল না। থানা থেকে সরে এসে মিত্র বাহিনীর কাছে বিমান সহায়তা চাইলে তখন তারা নিখুঁত নিশানায় বিমান সহায়তা করলে বিকাল ৫টার দিকে ঘাটাইল- গোপালপুর-মধুপুর-ধনবাড়ি মুক্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে ১০ তারিখ ৪টার পর প্রায় ঘণ্টা জুড়ে ছত্রীসেনা অবতরণ করে। ১০ তারিখ রাতের মধ্যেই প্রায় এক হাজার হানাদার কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। অন্যদিকে অবতরণ করা ছত্রীসেনা প্রবল বাতাসের কারণে কেউ কেউ মূল দল থেকে অনেকটা এদিক ওদিক ছিটকে পড়েছিল। ১০ তারিখ সারা রাত চলে তাদের একত্র করার কাজ। ৮০০ ছত্রীসেনার মধ্যে একটি গাড়ি এবং দুইজন সেনা গাছের ডালে লেগে মাটিতে পড়ায় আহত ও নিহত হয়। এরকম সামান্য ক্ষতি কোনো ছত্রীসেনা অবতরণে হয় না। এর চাইতে অনেক বেশি ক্ষতি হয়। ১০ই ডিসেম্বরের মধ্যে টাঙ্গাইল এলাকার পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণই কাদেরিয়া বাহিনীর অনুকূলে। ঢাকা-টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ এই একটি মহাসড়ক ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তানির দখল ছিল না। টাঙ্গাইলের উত্তরে ময়মনসিংহ-জামালপুর তখন মিত্র বাহিনীর দখলে। টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা মহাসড়ক পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ১১ই ডিসেম্বর দুপুরের পর টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত হলে আর ঢাকার দিকে কালিয়াকৈরের উত্তরে কোনো জায়গাতেই পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সম্পূর্ণ টাঙ্গাইল মুক্ত হয় ১১ই ডিসেম্বর। ১১ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইল হানাদার মুক্ত করতে ছোটখাটো যুদ্ধ হয় মাত্র দু’টি। একটি ইছাপুরে, আরেকটি টাঙ্গাইল জেলা সদরের পানির ট্যাংকের উপরে মেশিনগান নিয়ে বসে থাকা হানাদারদের বিরুদ্ধে। আমরা যারা উত্তর দিক থেকে টাঙ্গাইলের দিকে এগিয়ে ছিলাম তখন পুংলী ব্রিজের নিচে ছত্রীবাহিনীর অনেক সৈন্য অবস্থান নিয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার ক্লেরের পুরো ব্রিগেড এবং এক ব্যাটালিয়ান ছত্রীবাহিনী তারা যখন একে একে মহাসড়কে অবস্থান নিচ্ছিল সে এক দেখবার মতো দৃশ্য। এতদিন মানুষ পাকিস্তান হানাদারদের যুদ্ধযান দেখেছে, সাঁজোয়া বহর দেখেছে, এখন দেখছে মিত্র বাহিনীর সাঁজোয়া বহর। এ ব্যাপারে সব থেকে মজার হলো, ১০ তারিখ যখন ঝাঁকে ঝাঁকে ছত্রীসেনা নামছিল তখন টাঙ্গাইল শহরে অনেক দালালেরা তাদের সমর্থকদের সাহস দিতে বলে বেড়াচ্ছিল এই তো চীন সৈন্য পাঠিয়েছে। তারা নামছে আর ভয় নেই। এমনকি টাঙ্গাইল জামে মসজিদ থেকে মাইকে প্রচার করা হয়েছিল পাকিস্তানের আর কোনো ভয় নেই, চীনের সৈন্য এসে গেছে। কিন্তু বাস্তবে সেটা চীনের ছিল না, সেটা ছিল মিত্র বাহিনীর।
Discussion about this post