আল আমিন, নাটোর প্রতিনিধি :- নাটোর সদর উপজেলার লক্ষীপুর-খোলাবাড়িয়া গ্রাম। ঔষধি গাছের চাষাবাদের কারণে গ্রাম দুটিকে মানুষ ঔষধি গ্রাম হিসাবেই চেনে। এই গ্রাম দুটির কারণে নাটোর আলাদাভাবে পরিচিত পেয়েছে দেশজুরে। এই গ্রামে চাষ হয় ৪শ ধরণের ঔষধি গাছ। প্রায় ৪৫ বছর আগে ওই গ্রামে ঔষধি গাছের চাষ শুরু করেন আফাজ উদ্দিন। এলাকার সবাই তাকে আফাজ পাগলা নামে চেনে। কবিরাজির পাশা-পাশি তিনি নিজে ঔষধি গাছ চাষ করেই থেমে থাকেননি, অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করেছিলেন ভেষজ উদ্ভিদ চাষে। ‘তার স্বপ্ন, ছিল এখানকার গাছগাছড়া বিমানে করে একদিন বিদেশে যাবে। গত সাত বছর আগে আফাজ উদ্দিন মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আজ আশেপাশের ৩০টি গ্রামজুড়ে এখন ঔষধি গাছের চাষাবাদ হয়। বর্তমানে এ এলাকায় উৎপাদিত গাছ তাইওয়ান, জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আরব আমিরাতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এ ছাড়া শতশত প্রতিষ্ঠান এখানকার গাছগাছড়া থেকে ওষুধ ও প্রসাধনী তৈরি করে রপ্তানি করছেন। নাটোর শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দক্ষিণে লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নে, আমিরগঞ্জ, ইব্রাহিমপুর, খোলাবাড়িয়া, হাজীগঞ্জ, লক্ষীপুর, চৌরী, কাঠালবারিয়া, গাবতলীসহ ৩০টি গ্রামজুড়ে এখন ঔষধি গাছের চাষাবাদ হয়। খোলাবাড়িয়া গ্রামের আমিরগঞ্জ, ইব্রাহিমপুর, খোলাবাড়িয়া, হাজীগঞ্জ ও গাবতলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সবুজ গাছপালায় ঘেরা গ্রামের মাঝ দিয়ে চলে গেছে একটি পাকা সড়ক। সড়কের দুই পাশে চোখে পড়ে ঘৃতকাঞ্চন, শিমুলমূল, মিছরিদানার খেত। আগে এই গ্রামে শুধু বাড়ির আঙিনা ও আবাদি জমির আইলে ঔষধি গাছ চোখে পড়ত। এখন দৃশ্য পাল্টে গেছে। ধান-পাটের মতো বড় বড় জমিতে আলকুশি, অশ্বগন্ধা ও শতমূলের খেত চোখে পড়ে। যা সারা দেশের মানুষ ধীরে ধীরে নাটোর সদর উপজেলার এ গ্রামকে ‘ঔষধি গ্রাম’ বলে জানতে শুরু করে। স্থানীয় ভেষজ বিক্রিতা বলেন, এখানে দুই থেকে আড়াই ‘শ’ভেষজ পণ্য পাওয়া যায়। সারা বাংলাদেশ থেকে যারা পাইকার আছেন, তারা অনলাইনে ভেষজ পণ্য সংগ্রহ করেন। চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় গাছগাছড়া কুরিয়ারে পৌঁছে যাচ্ছে গ্রাহকের হাতে। কারখানা মালিক জালাল উদ্দিন বলেন, এখানকার গাছগাছড়া ভাঙ্গানোর কোন ব্যবস্থা ছিলনা । সর্ব প্রথমে আমি মেশিনের মাধ্যমে গাছগাছড়া প্রক্রিয়াত করার জন্য কারখানা স্থাপন করি। যার ফলে চুর্ন করা ভেষজ পাউডার সংরক্ষণ করতে পারছি। আফাজ উদ্দিন এর স্বজন ও গ্রামবাসী বলছেন, আগে খোলাবাড়িয়া গ্রামে দালান কোঠা কিছুই ছিলনা। এ গ্রামের উৎপাদিত গাছগাছড়া শহরের ফুটপাতে বা গ্রামের হাটবাজারে বিক্রি হতো। আফাজ উদ্দিনের নাম ধরেই আজ ঔষধি গ্রাম হয়েছে । প্রায় ৩০-৩৫টি গ্রাম মিলেই ঔষধি গ্রামের সৃষ্টি। ওনি গাছগাছড়া সংগ্রহ করে না আনলে ঔষধি গ্রাম হতো না। বর্তমানে এ এলাকায় উৎপাদিত গাছ দেশের বিভিন্ন জেলায় ও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এলাকার জয়নাল আবেদিন নামের ভেষজ উদ্যোক্তা বলছেন তিনি গড়ে তুলেছেন ভেষজ গাছের এক সংগ্রহশালা। সেখানে ৬শ প্রজাতির ভেষজ চারা রয়েছে। সেই চারা দেশের মনুষ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিদেশ থেকে লোকজন এসে তার কাছ থেকে সংগ্রহ করছে। গ্রামটির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আফাজ উদ্দিনের বাড়ি। তাঁর স্ত্রী হেলেনা বেগম বলেন, ‘পাগলের (আফাজ) ভক্তরা ভালোবাসি তাঁর কবর লালসালু দিয়া ঢাকি দিছে। বাঁচি থাকতে পাকা ঘরে ঘুমাতে পারিনি। এখন ছাদয়ালা পাকা ঘরে ঘুমাচ্ছে। ঔষধি গ্রাম করে তাঁর এটায় লাভ হয়ছে। স্থানীয় লোকজন বলেন, কয়েক বছর ধরে এ গ্রামে যা ঘটছে, তা আফাজ উদ্দিনের স্বপ্নের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। তাইওয়ান ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে গ্রামে উৎপাদিত ঘৃতকাঞ্চন (অ্যালোভেরা) প্রক্রিয়াজাত করে তাইওয়ান, জাপান, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আরব আমিরাতসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। শুধু এই একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিন প্রয়োজন পড়ে ২০ থেকে ২৫ মেট্রিক টন ঘৃতকাঞ্চন। এ ছাড়া স্কয়ার, এক্মিম, হামদর্দসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান এখানকার গাছগাছড়া থেকে ওষুধ ও প্রসাধনী তৈরি করে রপ্তানি করছে। ব্যবসায়ীরা বলেন, স্থানীয়ভাবে ঔষধি গাছগাছড়ার বাজারও বহুগুণ সম্প্রসারিত হয়েছে। গত দেড় যুগে এখানে নতুন করে শতাধিক ঔষধি পণ্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সে সময় গ্রামে প্রক্রিয়াজাতকরণের কোনো কারখানা ছিল না, এখন আছে সাতটি কারখানা। এসব কারখানায় শতাধিক প্রজাতির গাছগাছড়া প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে। গড়ে উঠেছে অর্ধশত আড়ত ও পাইকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এমনকি নতুন বাজার নামে একটি ওষধি বাজারও গড়ে উঠেছে। ওই বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ঔষধি ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি। সরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও ব্যাংকও তাঁদের ব্যবসায়ীদের অর্থের জোগান দিচ্ছে। জেলা প্রশাসক মিজ আছমা শাহীন বলেন, দেশের একমাত্র ঔষধি গাছের গ্রাম নাটোর। এখানকার চাষিরা কম জমিতে ভেষজ চাষাবাদ করে অন্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হচ্ছেন। তাই এর উৎপাদন ও ব্যবসা সম্প্রসারণ হচ্ছে। জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ এখানকার চাষিদের পাশে থেকে নানা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। খোলাবাড়িয়া গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন যুগ আগে এই গ্রামে শুধু বাড়ির আঙিনা ও আবাদি জমির আইলে ঔষধি গাছ চোখে পড়ত। এখন দৃশ্য পাল্টেছে। ধান-পাটের মতো বড় বড় জমিতে ঘৃতকাঞ্চন, শিমুলমূল, মিছরিদানা, রোজেলা, আলকুশি, অশ্বগন্ধা ও শতমূলের খেত চোখে পড়ে। চাহিদার পাশাপাশি প্রতিবছর চাষাবাদও বেড়ে চলেছে। এখানকার চাষি ও ব্যবসায়ীরা প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছেন। দোকানে দোকানে ইন্টারনেট সুবিধা, অনলাইন আদান–প্রদান ও প্রচার এখন নিত্যদিনের ঘটনা। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ অনলাইনে যুক্ত হয়ে রোগীরা চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় গাছগাছড়া কুরিয়ারে পৌঁছে যাচ্ছে গ্রাহকের হাতে। গ্রাম থেকে ফেরার সময় আমিরগঞ্জ বাজারে ঢুকে চোখে পড়ে, বাজারের ৫৬টি দোকানের ৫১টিই ভেষজ গাছগাছড়ার। এর একটির নাম ‘ভেষজ বাড়ি।’ ভেতরে ঔষধি গাছগাছড়াভর্তি সারি সারি প্লাস্টিকের পাত্র। পাত্রের গায়ে গাছের নাম লেখা। দোকানি মোস্তফা কামাল বলেন, তিনি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন এ ব্যবসায়। তাঁর মতো আরও অনেকে আছেন, যাঁদের বিনিয়োগ অনেক। তবে করোনাকালে বেচা-বিক্রি বন্ধ থাকায় তাঁরা ও চাষিরা অনেক লোকসানে পড়েছেন। এখন তাঁরা সে লোকসান পোষানোর চেষ্টা করছেন। ‘ঔষধি গ্রাম’ এ নামে গ্রামটিকে পরিচিত করে তোলার নেপথ্যে রয়েছেন আফাজ উদ্দিন পাগল। গ্রামের মানুষকে আত্মনির্ভরশীলতার পথও দেখিয়েছেন তিনিই। উৎসাহ, বুদ্ধি-পরামর্শ, সহযোগিতাও করেছেন ভেষজের চাষাবাদে। বদলে গেছে পুরো গ্রামবাসীর জীবনযাত্রা। বদলে গেছে তাদের চিন্তা চেতনা এবং কর্ম। এখন সবাই একই পথের পথিক, গ্রামজুড়ে পাগল আর পাগল, তবে গাছপাগল। এখন সব পাগল আছেন, কিন্তু আফাজ পাগল আর নেই। কিন্তু রয়েগেছে সৃতি।
Discussion about this post