বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আন্দোলন দমাতে কঠোর অবস্থানে আওয়ামী লীগ সরকার। চলছে দমনপীড়ন। তবে দাবি আদায়ে রাজপথ ছাড়েননি শিক্ষার্থীরা। তাদের মিছিল, স্লোগানে উত্তাল দেশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলির মুখে শিক্ষার্থীদের শক্ত অবস্থান। বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন তরুণ প্রাণ ঝরলেও পিছু হটছে না তারা। সেই অকুতোভয় তরুণদের একজন কাউসার মাহমুদ। তিনিও ঝাঁপ দিয়েছিলেন দ্রোহের আগুনে, যার উত্তাপ দেখা যায় গত ২ আগস্ট তাঁর ফেসবুক পোস্টে। সেদিন তিনি লিখেছিলেন, ‘আসছে ফাগুনে দ্বিগুণ নয়, ১৬ কোটি হবো’। ফেসবুকে এটাই ছিল তাঁর শেষ পোস্ট। আর কোনো ফাগুন ফিরে পাবেন না কাউসার। তবে তিনি থেকে যাবেন দেশের ১৬ কোটিরও বেশি মানুষের হৃদয়ে।
৪ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের নিউমার্কেট মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেন বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাউসার। এদিন দুপুরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে রণক্ষেত্র রূপ নেয় নিউমার্কেট এলাকা। এক পর্যায়ে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের লোকজন রাস্তায় ফেলে কাউসারের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। একের পর এক কিল, ঘুসি, লাঠি, লোহার রডের আঘাতে রক্তাক্ত করা হয় পুরো শরীর। পেটে লাগাতার লাথি মারতে থাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এমন বর্বর হামলায় কাউসারের দুটি কিডনি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে লিভারে ইনফেকশন ধরা পড়ে। মাথায় আঘাত পাওয়ায় দেখা দেয় মানসিক সমস্যা। এসব জটিলতা নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ছুটতে থাকেন। সর্বশেষ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।
কাউসারের মৃত্যুর খবরে মোগলটুলি এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া, যার আঁচ পাওয়া গেল গতকাল সোমবার বিকেলে। মোগলটুলিতে কাউসারদের বাসার গলির সামনে যেতেই একজন বললেন, ‘এভাবে এত অল্প বয়সে কেন কাউসারকে চলে যেতে হলো?’
গফুর সওদাগর ভবনের দুই তলা টপকে তৃতীয় তলায় উঠতেই দেখা যায় মানুষের জটলা। সিঁড়ির বাঁ পাশের বাসাটি কাউসারদের। বাসার প্রথম কক্ষে ছোট একটি খাটে থাকতেন কাউসার। সেই খাটে অনেকের সঙ্গে বসে ভাইয়ের স্মৃতি হাতড়ে বিলাপ করছেন সুলতান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘কেন আমার ভাইয়ের এমন করুণ পরিণতি হলো? ও তো কারও ক্ষতি করেনি। আমি এখন কাকে ভাইয়া বলে ডাকব? তাঁকে ছাড়া আমার মা-বাবা কীভাবে বাঁচবে?’
কাউসারের বাবা আব্দুল মোতালেব কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে বড় ডিগ্রি নেবে। চাকরি নিয়ে সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন পূরণ হতে দিল না পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকজন। সে প্রতি ক্লাসে প্রথম হতো। তার পুরস্কারে বাড়ির শোকেস ভর্তি। এই শোক আমি কীভাবে সহ্য করব!’
তিনি জানান, আহত হওয়ার পর পর ১৭ দিন অচেতন ছিলেন কাউসার। মাঝে মাঝে রক্ত বমি করতেন। বিড়বিড় করে কথা বলতেন নিজের সঙ্গেই। চিকিৎসায় প্রায় ১৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ করে জোগাড় করেছেন আব্দুল মোতালেব। বাকি টাকা বিভিন্ন জায়গা থেকে সহায়তা পেয়েছেন।
আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘কাউসার জুলাই মাসজুড়ে বিভিন্ন সময় ফেসবুকে কোটা আন্দোলন ও সরকারের সমালোচনা করে নানা পোস্ট দিয়েছে। সেগুলো এক দিন ডিলিট করতে বললে আমাকে বলে, বাবা অপেক্ষা করেন, আমাদের বিজয় আসবেই, বাতিলের শক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। আমার ছেলের রক্তের বিনিময়ে নতুন বাংলাদেশ এসেছে। এই দেশে আর যেন কারও বুক খালি না হয়।’
গতকাল দুপুরে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রথম জানাজা শেষে কাউসারের মরদেহ চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। রাতেই দ্বিতীয় জানাজা শেষে আব্দুর রহমান মাতব্বর জামে মসজিদের পাশের কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
কাউসারের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন তাঁর বন্ধু, সহপাঠীসহ পরিচিত-অপরিচিত অনেকে। আরমান হোসেন রিফাত নামে তাঁর এক বন্ধু ফেসবুকে লিখেছেন, ‘দুই বছরের ভার্সিটি লাইফে তোর সাথে ছোট ছোট অনেক মেমোরি আছে। তোর সাথে আর দেখা হবে না, একসাথে আর আড্ডা দেওয়া হবে না– এটা চিন্তা করতে পারছি না। অনেক মিস করবো রে।’
Discussion about this post