ভারতের অন্যতম শীর্ষ শিল্পপতি ও টাটা গ্রুপের কর্ণধার রতন টাটা মারা গেছেন। বুধবার রাতে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার মৃত্যুতে আবেগঘন বার্তা দিয়েছেন ভারতের অন্যতম ধনী শিল্পপতি ও রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মুকেশ আম্বানি। বৃহস্পতিবার (১০ অক্টোবর) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
রতন টাটার মৃত্যুতে দেওয়া আবেগঘন বার্তায় ব্যবসায়িক কারণে রতন টাটার সঙ্গে তাঁর আলাপের পাশাপাশি তাঁদের ব্যক্তিগত আলাপের কথাও তুলে ধরেন মুকেশ আম্বানি। এ সময় রতন টাটাকে নিজের ‘বন্ধু’ হিসেবে সম্বোধন করেন তিনি।
মুকেশ আম্বানি বলেন, আজ গোটা ভারত এবং ভারতীয় ব্যবসায়িক জগতের জন্যে শোকের দিন। রতন টাটার মৃত্যু শুধুমাত্র টাটা গোষ্ঠীর জন্যে বেদনাদায়ক নয়, প্রতিটি ভারতীয়র জন্যেই তা বেদনাদায়ক। ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন পরম বন্ধুকে হারালাম। তার সঙ্গে আমার যতবার দেখা হয়েছে তিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তিনি একজন দূরদর্শী শিল্পপতি ও সমাজসেবক ছিলেন। তিনি সমাজের মঙ্গল চাইতেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, আজ ভারতমাতা তার অন্যতম সহৃদয় সন্তানকে হারিয়েছে। রতন টাটা ভারতকে গোটা বিশ্ব দরবারে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বের সেরাটা ভারতে নিয়ে এসেছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি টাটার চেয়ারম্যান হওয়ার পরে সংস্থাটিকে ৭০ গুণ বড় করেছেন।
মুকেশ আম্বানি বলেন, গোটা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রি, নীতা এবং আম্বানি পরিবারের পক্ষ থেকে টাটা পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে চাই। রতন সবসময় আমাদের হৃদয়ে থাকবে।
ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ সিন্দে তাকে ভারতের কোহ-ই-নূর বলেন উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, তিনি (রতন টাটা) ছিলেন রত্ন, ভারতের কোহ-ই-নূর। তিনি মারা গেছেন, এবং এটা খুবই বেদনাদায়ক। গোটা দেশ ও মহারাষ্ট্র তাকে নিয়ে গর্বিত। এত উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি একজন সরল ও বিনয়ী ব্যক্তি ছিলেন।
১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুম্বাইয়ে পারসিক পরিবারে জন্ম রতন টাটার। বাবা নভল টাটার জন্ম গুজরাটের সুরতে। পরে টাটা পরিবার তাকে দত্তক নেয়। রতন টাটার মা সুনি টাটা আবার সরাসরি জামশেদজি টাটার পরিবারের অংশ। রতন টাটার পিতামহ হরমসজি টাটা জন্মসূত্রেই ওই পরিবারের সদস্য। রতন টাটার যখন ১০ বছর বয়স, সেই সময় তার মা-বাবা আলাদা হয়ে যান। রতন টাটার নিজের এক ভাইও রয়েছেন, জিমি টাটা। সৎ ভাই নোয়েল টাটা। নভল টাটা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সিমোন টাটাকে। নোয়েল তাদেরই সন্তান।
মুম্বাই, শিমলা হয়ে নিউইয়র্কের রিভারডেল কান্ট্রি স্কুলে পড়তে যান রতন টাটা। ১৯৫৯ সালে স্থাপত্য নিয়ে স্নাতকস্তরে ভর্তি হন কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। সাতের দশকে টাটা গ্রুপে ম্যানেজার পদে দায়িত্ব পান রতন টাটা। ১৯৯১ সালে জেআরডি টাটা দায়িত্ব ছাড়লে রতন টাটাকে নিজের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। প্রথমে তাকে নিয়ে আপত্তি ছিল গ্রুপের ভেতরে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে তার।
যে ২১ বছর রতন টাটার হাতে টাটা গ্রুপের দায়িত্ব ছিল, তাতে গ্রুপের আয় বেড়ে হয় ৪০ গুণ, মুনাফা বাড়ে ৫০ গুণ। মধ্যবিত্তকে চার চাকার স্বপ্ন দেখান রতন টাটাই। পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা গড়ে ওঠে। যদিও রাজনৈতিক টানাপড়েনে পরে গুজরাতে কারখানা সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়।
৭৫ বছর বয়সে ২০১২ সালে টাটা গ্রুপের নির্বাহী ক্ষমতা ছেড়ে দেন রতন টাটা। সেই জায়গায় পারিবারিক আত্মীয় সাইরাস মিস্ত্রিকে আনা হয়। কিন্তু ২০১৬ সালে সাইরাসকে টাটা সন্সের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ফের অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্বে ফেরেন রতন টাটা। এরপর ২০১৭ সালে নটরাজন চন্দ্রশেখরণকে অন্তর্বর্তীকালীন চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সমাজসেবামূলক কাজে আরও বেশি করে যুক্ত হন রতন টাটা।
২০০০ সালে ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান পান রতন টাটা। ২০০৮ সালে পান ‘পদ্ম বিভূষণ সম্মান’। মহারাষ্ট্র, আসাম সরকারও তাকে সম্মান প্রদান করে। ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স, আইআইটি বম্বে, ইয়েল ইউনিভার্সিটি, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, রাজা তৃতীয় চার্লসের থেকেও বিশেষভাবে সম্মানিত হন।
রতন টাটা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হননি। তবে ২০১১ সালে একটি সাক্ষাৎকারে জীবনে প্রেম এসেছিল বলে স্বীকার করে নেন। চার-চারবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার উপক্রম হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক পরিণতি পায়নি বলে জানান।
Discussion about this post