সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন নোয়াখালীর সেনবাগের রসুল করিম। তার চোখেমুখে এক ধরনের উচ্ছ্বাস আর আনন্দ লক্ষ্য করা গেল।
গত সোমবার বেলা সোয়া ১২টায় দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালাল বিমানবন্দরে কথা হয় এই যাত্রীর সঙ্গে।
সেই উচ্ছ্বাস ঠিক কী কারণে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিমানবন্দরে যে চিত্র দেখলাম, এ রকম আগে চোখে পড়েনি। বিশেষ করে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের ব্যবহার পুরাই চেঞ্জ। সবাই ‘স্যার’ বলে ডাকছেন।”
“এই ১৬ বছরে কখনও ইমিগ্রেশনে এমন চিত্র চোখে পড়েনি। এরপর আমি ইমিগ্রেশন শেষ করে বেল্টে যাওয়ার আগেই লাগেজ পৌঁছে গেছে। এটা ভাবাও যায়নি কিছু দিন আগেও।”
বিমানবন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ৮ অগাস্ট থেকে মুহাম্মদ ইউনূস সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শাহজালাল বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক), গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস, ইমিগ্রেশনসহ বেশ কিছু বিভাগে সর্বোচ্চ পদ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের রদবদল করা হয়। এরপর থেকেই বিমানবন্দরে যাত্রীসেবায় পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।
শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর ৯০ লাখের বেশি যাত্রী বিমানবন্দরটি ব্যবহার করেন, চলাচল করে ১ লাখের বেশি ফ্লাইট। ৩৪টির বেশি যাত্রী ও কার্গো এয়ারলাইনস বিশ্বের ৬০টির বেশি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করে এই বিমানবন্দর ব্যবহার করে।
দীর্ঘদিন ধরে শাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে বিলম্ব হওয়া, লাগেজ থেকে মালামাল চুরি, দেরি করে লাগেজ পাওয়াসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি এই চিত্র পাল্টাতে শুরু করেছে, যা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
সোমবার দুপুর সোয়া ২টায় নেপালের কাঠমান্ডু থেকে (বিজি-৩৭২) ঢাকায় পৌঁছায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট। ট্যুরিস্ট ভিসায় নেপালে যাওয়া আরাফাত হোসেন সেই ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন। তিনি ঢাকার নিউ মার্কেট এলাকার বাসিন্দা।
আরাফাতের কাছে বিমানবন্দরে সেবা পাওয়ার বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ফ্লাইট থেকে নেমে দ্বিতীয় টার্মিনাল দিয়ে বের হতে সময় লেগেছে ৩৫ মিনিটের মত। সাধারণত প্লেন থেকে নামার পর ইমিগ্রেশন, লাগেজ সংগ্রহসহ অন্য ফর্মালিটি মেনে বের হতে গড়ে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। আজ প্রায় ৪০ মিনিটেই লাগেজসহ বিমানবন্দর থেকে বের হতে পেরেছি।
“আবার বিমানবন্দরের ভেতর থাকা ফ্রি টেলিফোন নাকি কাজ করছে শুনলাম। আগে করত না। সেটা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেছি।”
এদিন ওমান এয়ারের একটি ফ্লাইটে (ডব্লুওয়াই-৩১৭) বেলা ৩টায় বাংলাদেশে পা রাখেন কুমিল্লার নাঙ্গলকোর্টের আশরাফুল আলম।
নিজের অভিজ্ঞতা শুনিয়ে তিনি বলেন, “২০১৭ সালে আমি ওমানের মাসকাট থেকে একবার দেশে আসি, বিমানবন্দরে নেমে দেখি লাগেজ কাটা। ভেতরে অনেক মালামাল নেই। সেবার বাড়ি ফিরে মন খারাপ ছিল খুব। এবার একদম কম সময়ে লাগেজ হাতে পেলাম। এরপর আমি সিম নিয়ে আসি নাই। এর আগে কাউকে রিকোয়েস্ট করে ফোন দিতাম। এবার দেখি টেলিফোন সেন্টার চালু।
“আর ইমিগ্রেশন থেকে বের হওয়া পর্যন্ত স্যার ছাড়া কথাই বলল না। ব্যাস, আর কী চাই! প্রবাসীদের এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার থাকে না আসলে।”
সৌদি আরবের রিয়াদ থেকে বিমানের একটি ফ্লাইটে (বিজি-৩৪০) সোমবার বিকাল ৪টায় দেশে ফেরেন ফেনীর আকমল হোসেন।
অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে আকমল বলেন, “বিমানবন্দরে যাত্রীসেবার উন্নতি হয়েছে, এটা আনন্দের। আমরা ইমিগ্রেশন আগের চেয়ে দ্রুত সম্পন্ন করতে পারলাম, সবচেয়ে বড় কথা লাগেজ পেয়েছি অক্ষত; এটাই ছিল বড় টেনশনের কারণ, যা এখন স্বস্তির।”
ব্যবসায়ের কাজে নিয়মিত দেশে এবং বিদেশে যাতায়াত করেন ঢাকার মগবাজারের নুযহাত তাবাসসুম।
কক্সবাজার থেকে ফিরে তিনি বলেন, “বিমানে যাতায়াতের একটা অন্যতম পার্ট ইমিগ্রেশন। সেটা আগের থেকে দ্রুত হচ্ছে, এটা স্বস্তির। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, শাহজালালে লাগেজ চুরির যে বদনাম ছিল, সেটা কমেছে। যথাসময়ের আগেই লাগেজ পাচ্ছি ইদানীং। এটা আমাদের জন্য আনন্দের।”
কীভাবে এই পরিবর্তন
যাত্রীসেবায় গতি এসেছে কীভাবে- জানতে চাইলে দেশের বিমানবন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিমানবন্দরে কাজ করা ২৪টি সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছি। যেহেতু যাত্রীসেবার বিষয়টি একটা টিমওয়ার্ক; আমি তাদের মোটিভেট করার চেষ্টা করেছি।
“তারা তাদের জায়গা থেকে ফিল করেছে যে, আমাদের সবচেয়ে বেস্ট সার্ভিসটাই দেওয়া উচিত। সে জায়গা থেকে তারা কাজ করছে। সে জন্য ক্রেডিটটা শতভাগই তাদের। আমরা চেষ্টা করছি, যাত্রীরা যাতে লাগেজটা দ্রুত পায়, তাদের ইমিগ্রেশনটা দ্রুত সম্পন্ন হয়।
“আমি সব বিষয় উপর্যুপরি তদারকি করছি। আমরা চাই, যাত্রীরা যেন সবচেয়ে ভালো সেবাটা পায়।”
যাত্রীসেবার মানের এই পরিবর্তন কীভাবে হয়েছে, জানতে চাইলে শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. কামরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা একটা কন্টিনিউয়াস প্রোসেস, আমরা প্রতিনিয়ত এটা নিয়ে কাজ করছি। চেষ্টা করছি, যাত্রীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার। এটা আসলে একটি টিম ওয়ার্ক।
“যেটা হয়েছে আমরা এখন বিমানবন্দরে লাগেজগুলো দ্রুত দিতে অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটি কর্তৃক র্যাম্প কন্ট্রোল যেটা আগেও ছিল, আরও বেগবান করেছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা সেটা হল, আগে আমাদের ইমিগ্রেশনে তিনটা শিফটে কর্মকর্তারা কাজ করতেন ৮ ঘণ্টা করে। এখন থেকে একটি শিফট বাড়িয়ে ৪ শিফট করা হয়েছে। যেটা আমরা অনেক দিন ধরেই করার চেষ্টা করছিলাম।”
কাজের বেশি চাপ থাকলে কর্মকর্তারা চাইলেও অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত সেবাটা দিতে পারেন না। ফলে শিফট বাড়ায় যাত্রীরা ইমিগ্রেশনে আরও সুন্দর ব্যবহার ও আন্তরিক সেবা পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
কামরুল ইসলাম বলেন, “এই মুহূর্তে আমাদের বিমানবন্দরের হেল্প লাইন কলসেন্টারও পুরোপুরি কাজ করছে। যেটি ২০২৩ সালের ২৭ জুলাই চালু হয়। প্রতিদিন শত শত কল পাচ্ছি। বিমানবন্দরে ফ্রি ওয়াফাই সার্ভিসও চালু রয়েছে।
“আমরা গত এক বছরে প্যাসেঞ্জারদের ভালো সেবা দেওয়ার জন্য স্টাফদের অনেক কোর্স করিয়েছি। এজিবিসহ নতুন কিছু বাহিনীর সদস্যও নিরাপত্তায় যুক্ত হয়েছেন। সব মিলিয়েই আসলে যাত্রীরা ভালো সেবা পাচ্ছেন।”
তবে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাও সামনে আসছে। বিদেশফেরত এক যাত্রীর সঙ্গে ‘অসদাচরণ’ ও ব্যাগ খুলে চকলেট নেওয়ার অভিযোগে তিন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাকে (এআরও) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
ঢাকা কাস্টম হাউজের কমিশনার মোবারা খানম জানান, বহিষ্কৃতরা হলেন- মো. আজিজুল হক, শিমুল চৌধুরী ও আল আমিন।
তবে বিমানবন্দর পরিচালনা কর্তৃপক্ষ বলছেন, এ ধরনের ঘটনা ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
Discussion about this post