ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এ সরকারের মূল লক্ষ্য, বাংলাদেশকে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা। এ সংস্কারকাজে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহায়তা দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সমকালের সঙ্গে আলাপকালে এমনটাই জানিয়েছেন ঢাকা সফর করে যাওয়া মার্কিন অর্থ দপ্তরের আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও উন্নয়নবিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান এবং দেশটির উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অঞ্জলি কৌর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাসনিম মহসিন
সমকাল: ব্রেন্ট, প্রথমেই বাংলাদেশে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের সুযোগ সম্পর্কে জানতে চাই। বাংলাদেশ বর্তমানে সংকটময় মুহূর্তে রয়েছে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত করার জন্য কোনো সুযোগ দেখতে পাচ্ছেন?
ব্রেন্ট নেইম্যান: যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক খুবই শক্তিশালী, এ সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশি পণ্যের বৃহত্তম গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র; সেই সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম বড় বিনিয়োগকারী দেশও। বাংলাদেশে কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক আরও বাড়াতে ও গভীর করতে বাংলাদেশের ক্রমাগত স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করা, দুর্নীতি দমন করা, যথাযথ মুদ্রানীতি এবং বাজেটনীতি নির্ধারণ করার মতো কাজগুলো করতে হবে, যেসব চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করেছি। কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে এবং যেকোনো সহায়তা দিতে প্রস্তুত। কিছু বিষয়ে সংস্কার বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন। তবে বাংলাদেশ এটি করতে প্রস্তুত, যা এ দেশের জন্য দুর্দান্ত সুফল নিয়ে আসবে। আমরা বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে আগ্রহী।
সমকাল: কীভাবে বাংলাদেশ আরও বেশি মার্কিন বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে? সেই সঙ্গে রপ্তানির নতুন সম্ভাব্য গন্তব্য খুঁজতে পারে?
ব্রেন্ট নেইম্যান: বাংলাদেশ তার অর্থনীতির তুলনায় এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশ থেকে বিনিয়োগ আকর্ষণে পিছিয়ে রয়েছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে, তখন তাদের ব্যবসায়িক কৌশলসহ ব্যবসায়িক পরিবেশে অন্যান্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন উপায়ে তাদের কর্মী প্রশিক্ষণ বা ক্রয় পরিচালনার জন্য প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই উচ্চমান ও মূল্যবোধের সঙ্গে পরিচালিত হয়। ফলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হতে পারে। সেই সঙ্গে এটি রপ্তানি এবং উৎপাদন বৈচিত্র্যকরণেও সহযোগিতা করতে পারে। তাতে পণ্যের উন্নয়ন, নতুন দক্ষতা, নতুন চিন্তার মাধ্যমে উদ্ভাবনের সম্ভাবনা তৈরি করে।
বাংলাদেশ সফরে আমরা বুঝতে চেষ্টা করেছি মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে বিনিয়োগের বাধা কই। তাদের পক্ষ থেকে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এসেছে, যা নিয়ে আমরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করে দূর করব বলে আশা করছি। প্রতিবন্ধকতার মধ্যে নীতিগত, বৈদেশিক মুদ্রার মতো বিষয়গুলো রয়েছে। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ ইউএসএআইডি বা অর্থ দপ্তরের সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে কিছু গবেষণা ও কারিগরি সহযোগিতা নিতে পারে।
সমকাল: বর্তমানের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে?
ব্রেন্ট নেইম্যান: বাংলাদেশকে এ ধরনের বিশেষজ্ঞ সহায়তা দেওয়ার মতো অনেকেই রয়েছে। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও একটি দেশ। ফিন্যান্সিয়াল ইনটিলিজেন্ট ইউনিট শক্তিশালী করা বা তাদের রাজস্ব ব্যবস্থাপনা উন্নত করা বা তাদের ক্ষতিকারক সম্পদ বা খেলাপি ঋণ বা ব্যাংকিং খাতের সমস্যা মোকাবিলা করার বিষয়ে সহায়তা করার মতো বিষয়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে পারে।
সমকাল: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইউএসএআইডি কি কৌশলগত সহায়তার মাধ্যমে সংস্কার উদ্যোগে সহযোগিতা করবে?
অঞ্জলি কৌর: এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অগ্রাধিকার। যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। এজন্য কারিগরি সহায়তা ও পরামর্শ দেওয়ার মতো বিষয়গুলোতে এগিয়ে আসব। যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশে যেভাবে সহযোগিতা করেছে, সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করব। বাংলাদেশের সরকারের কাছ থেকে আমরা খুব স্পষ্টভাবে শুনেছি যে তারা দুর্নীতিবিরোধী সরকার হিসেবে পরিচিতি পেতে চায়। এটি আমাদের জন্য একটি চমৎকার বার্তা। আমরা এ প্রচেষ্টায় সহায়তা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। সেই সঙ্গে তরুণরা যাতে দক্ষ হয়ে ওঠে, চাকরি ও জীবিকার সুযোগ পায়, তা নিশ্চিতে কাজ করব।
সমকাল: আর্থিক সংকট বিশেষ করে ডলার সংকট কাটাতে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করতে পারে?
ব্রেন্ট নেইম্যান: বাংলাদেশে আইএমএফের প্রোগ্রামের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় আইএমএফের সঙ্গে শক্তিশালী যোগাযোগ তৈরি এবং আইএমএফের প্রোগ্রাম-ভিত্তিক সংস্কারের ক্ষেত্রে উৎসাহিত করছি। এছাড়াও, আমরা অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতার বিষয়টিও বলেছি। যুক্তরাষ্ট্র আশা করে বাংলাদেশ পদক্ষেপগুলো নেবে এবং সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণ পাবে।
সমকাল: রোহিঙ্গা সংকট সমাধান এবং প্রত্যাবাসনে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে পারে?
অঞ্জলি কৌর: প্রথমেই আমি এতদিন ধরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। যুক্তরাষ্ট্র তার দায়িত্ব পালন করছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন ও পুষ্টির মতো বিষয়গুলোতে সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে। তবে পরিস্থিতি উন্নয়নে আমাদের আরও কিছু করার রয়েছে। যেমন যদি রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে জীবিকা অর্জনের সুযোগ দেওয়া হয়, তবে আরও টেকসই এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারবে, যা আমরা সবাই চাই। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক, তবে সেটি শুধু তখনই যখন সেখানকার পরিবেশ সহায়ক হবে এবং তাদের জন্য নিরাপদ হবে।
সমকাল: অর্থ পাচার ও দুর্নীতি রোধে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে?
ব্রেন্ট নেইম্যান: আগেই বলেছি, বাংলাদেশের আইএমএফের প্রোগ্রামের মাধ্যমে অর্থ পাচার রোধ ও দুর্নীতিকে আটকাতে পারে। ফলে আইএমএফ প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত একটি উপায় হতে পারে।
সমকাল: জলবায়ু পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে?
অঞ্জলি কৌর: জলবায়ুতে অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি মাথায় রেখে স্মার্ট কৃষিকাজের বিষয়টি তুলে ধরতে চাই। বাংলাদেশে কৃষক ও কৃষি অঞ্চল ঝুঁকিতে পড়ছে। ফলে আমরা এমন বীজের বিষয়ে চিন্তা করছি, যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এছাড়া উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও চিন্তা করছি। কীভাবে সরকার উপকূলকে রক্ষা করবে, তা নিয়ে অতীতেও আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করেছি, ভবিষ্যতেও করব।
সমকাল: ব্রেন্ট নেইম্যান ও অঞ্জলি কৌর আপনাদের দু’জনকে সমকালের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।
ব্রেন্ট নেইম্যান: আপনাকেও ধন্যবাদ।
অঞ্জলি কৌর: আপনাকেও ধন্যবাদ।
Discussion about this post