“চাষের টাইমে চাষ করি, নইলে বালুর মহালে বালু তুলি। এখনতো সব শেষ… কিছু করিওতো খাইত পারুম না। কেমনে যে চলুম তা আল্লায় জানে।”
কথাগুলো বলছিলেন ফেনীর পরশুরাম উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী মীর্জানগর ইউনিয়নের কাউতলী গ্রামের যুবক হারুণ। হরকা বানের পানিতে সবকিছু তলিয়ে যাওয়া এ গ্রামের অধিকাংশ যুবক তার মত সঙ্কটে পড়েছেন।
চাষের জমিতে জমে আছে বালুর স্তূপ, আবার বালু মহাল ভেসে গেছে পানিতে। ফলে গ্রামের অধিকাংশ যু্বকের সামনে ঘোর অন্ধকার। পরিবার পরিজন নিয়ে সামনের দিনগুলোতে বেঁচে থাকার জন্য এখন তাদের নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হবে।
পরশুরামের উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজা হাবিব শাপলার মনেও এলাকার মানুষের কর্মস্থান নিয়ে শঙ্কা।
তিনি বলেন, “কৃষি ধ্বংস হয়ে গেছে। মানুষের হাতে কোনো কাজ নাই। তাদের পুনর্বাসন করাটা এখন জরুরি।”
গত ২০ অগাস্ট অতিবৃষ্টি আর হরকা বানের পানিতে তলিয়ে যায় ফেনী সদরসহ সবকটি উপজেলা। আগে কখনও এমন বন্যার মুখোমুখী না হওয়া মানুষগুলোর জীবনে নেমে আসে দুঃস্বপ্ন।
ভারত সীমান্তবর্তী পরশুরাম উপজেলার মানুষ বলছে, বর্ষা মৌসুমে খাল, বিল, নদীতে অতিরিক্ত পানি থাকে, কিছু নিচু এলাকা পানিতে ডুবেও যায়। কিন্তু সব ভাসিয়ে নেওয়া এমন বন্যা তাদের এলাকায় নজিরবিহীন।
এর আগে গত ১ জুলাই প্রথম বন্যা কবলিত হয় এ উপজেলা। পরের বার গত ২ অগাস্ট বাধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে আবার। বাঁধটি সাময়িকভাবে সংষ্কার করা হলেও ২০ অগাস্ট অতি বৃষ্টি আর ঢলের পানিতে বাধের বেশকিছু অংশ ভেঙে যায়। সে অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে সৃষ্টি হয় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার।
পরশুরামের মীর্জানগর ইউনিয়নের তুলাতলী বাজারে কথা হয় হারুণের সঙ্গে। বানের পানিতে গ্রামে কেমন ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে বলে উঠেন- “আমার লগে চলেন, ঘুইরা দেখাই। নিজের চোখে না দেইখল্লে বিশ্বাস কইরতে পাইরতান ন।”
হারুণকে সাথে নিয়ে ইউনিয়নের কাশিনগর, উত্তর কাউতলী, দক্ষিণ কাউতলী ও চম্পক নগর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় বেশির ভাগ ফসলি জমিতে জমেছে বালুর স্তূপ। বন্যার আগে আবাদ করা আমন ধানের চারাগুলো বালুর নিচে চাপা পড়েছে।
গ্রামের পথ ধরে হাঁটার সময় বিভিন্ন জমিতে বালুর স্তূপ দেখিয়ে দিয়ে হারুন বলেন, এগুলো সব ফসলি জমি। বন্যার আগে আমন ধান রোপন করা হয়েছিল। এখন সব শেষ। বালু না সড়ালে আর চাষাবাদও করা যাবে না।
হারুণের ভাষ্য, জমি চাষ করেই জীবিকা চলে তার। আর চাষের কাজ না থাকলে স্থানীয় বালুর মহালে বালু তোলার শ্রমিকের কাজ করেন। তার মত গ্রামের অধিকাংশ যুবক ও মাঝবয়েসী পুরুষের পেশা এটা।
কাশিনগর গ্রামে গিয়ে কথা হয় বিভিন্ন বয়েসী কয়েকজনের সঙ্গে। তাদের একজন ইসমাইল হোসেন জানালেন, জমিতে চাষ করেছিলেন। কিন্তু বানের পানিতে বালুর স্তূপ জমে সব শেষ।
“বালু তুলি, না হলে মাইনস্যের ঘরে কামকাজ করি। এখনতো কোন কাজ নাই, মানুষ নিজেই বাঁচে না আমাগোরে কী কাজ দিব!”
তুলাতলী বাজারের চা দোকানী আব্দুল কাদের জানান, গ্রামের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ করে। এবারের বন্যায় তারা সবাই পথে বসেছে। গ্রামে নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা্ বেশি। তাদের সব কাজের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
হারুণ বলেন, কয়েকদিন ধরে রোদ ওঠায় প্রতি ঘরের মানুষ বন্যার পানিতে ভিজে যাওয়া ধান শুকাতে ব্যস্ত। অনেকের ধান পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে।
“ঘরে বছরের ধান মজুদ রাখি বাকিগুন বেঁচি, কিন্তু বানের হানিত সব শেষ। ক্যামনে ভাত খামু, কী করমু, কিছুইতো বুইতাছি না। মন কয় যেন মরি যাই।”
Discussion about this post