প্রতিবেশীর চুলায় গোস্ত রান্না হচ্ছে দেখে নিজেও বাবার কাছে গোস্ত খাওয়ার বায়না ধরেছিল ছয় বছর বয়সী সায়মা সুলতানা শ্রাবন্তি। কিন্তু বন্যার মধ্যে দিনমজুর বাবা সালাহ উদ্দিনের আয়-রোজগার যে বন্ধ!
পরিবার নিয়ে কোনোরকমে টিকে থাকার এই সময়ে মেয়ের আবদার মেটানোর সম্ভব ছিল না সালাহ উদ্দিনের পক্ষে। কিন্তু নাছোড়বান্দা মেয়ের কান্নাকাটিতে সেই প্রতিবেশী গরুর সিনার সাত-আটটি হাড় দেন। সেই হাড় মূলা দিয়ে রান্না করে মেয়েকে শান্ত করেছেন মা রওশন।
চোখের জল মুছতে মুছতে সেই গল্প শুনিয়ে সালাহ উদ্দিন বলেন, “মাইয়াডা কিছু বুঝে ন। হাড্ডির উফরের রাবারগুলা টানি টানি খাইছে। গোস্ততো নাই, ওইগুন দিয়াই কয়ডা ভাত খাইছে।”
লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জ থানার রাজাপুর মিয়াজি বাড়ির বাসীন্দা সালাহ উদ্দিন পরিবার নিয়ে ১২ দিন ধরে আছেন কফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে। কাজ নেই তাই আয়ও নেই। আপাতত ত্রাণ হিসেবে যা মিলছে, তার সঙ্গে ধার-দেনা করে কোনমতে চলছে চার সন্তান আর স্বামী-স্ত্রীর পেট।
রোববার কফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে বসে সালাহ উদ্দিন জানালেন, এই ১২ দিনে ত্রাণ হিসেবে তিনি ৬ কেজি চাল পেয়েছেন। এছাড়া নিজের বাড়ি থেকে কিছু চাল আর চিড়া-মুড়ি বাঁচিয়ে আনতে পেরেছিলেন। তাই দিয়ে তাদের দিন চলছে।
স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ২ কেজি চাল লাগে সালাহ উদ্দিনের পরিবারে। সেখানে এখন গড়ে আধা কেজিও মিলছে না। রোববার তিনি চাল যোগাড় করেছেন ধার করে।
যখন যে কাজ পান তাই করে সংসার চালান মধ্যবয়সী এই দিনমজুর। তিনি বলেন, “মাসখানেক ধরি কাম-কাইজ নাই। কয়দিন আছিল অবরোধ আন্দোলন, এরপর বর্ষা (বৃষ্টি), এহন বইন্যা।
“হেদিন (গতকাল) পাশের রুমের আরেক ফ্যামিলি ফ্রিজেরতুন গোস্ত বাইর কইচ্চে। ওইডা দেখি আমার ছোড মাইয়াডা গোস্ত খাইবার লাগি কান্নাকাডি শুরু কইচ্চে। মাইয়াডার কান্না দেখি ওনারা একটা পোটলা দিছে। খুলি দেখি ৭-৮ পিস সিনার হাড্ডি। পরে এগুনই মূলা দি রান্দি দিছে। ছোড মানুষ কিছু বুজেনা।”
তার ১৭ বছর বয়সী বড়মেয়ে সালমা পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। মেজ মেয়ে সাবিনা সপ্তম, ছেলে শ্রাবণ চতুর্থ আর ছোটমেয়ে শ্রাবন্তি দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। বড় দুইজন মাদ্রাসায় পড়ছে আর ছোট দুইজন পড়ছে স্থানীয় একটি স্কুলে।
তাদের পড়াশোনার মূল খরচটা সমিতি থেকে কিস্তি তুলে চালিয়ে নিচ্ছেন সালাহ উদ্দিন। তিনি বলেন, “এত এত দিতাম হারিনা। ইনকাম আর খরচ মিলাইতাম হারিনা। দৈনিক ধরেন ৫০০ টাকা ইনকাম, এরমইদ্যে আঁর ১০০ টাকা খরচ আছে। এরহরে সংসার খরচ। তাগো বেতনগুলা ফাইনাল হরিক্ষার সময় কিস্তি লই পেইড করি। পরে না খাই অইলেও সপ্তাহে সপ্তাহে পরিশোধ করি।”
সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার টাকা কিস্তি তুলে ঘর মেরামত করেছেন। আর ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার কিছু খরচ দিয়েছেন। কিন্তু সেই মেরামত করা ঘরই বন্যায় হেলে পড়েছে। পড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রোববার গিয়ে বাঁশ বেঁধে টানা দিয়ে এসেছেন।
সালাহ উদ্দিন বলেন, “পানি হয়তো এক সপ্তাহ পর শুকাই যাইব। এখন ঘরদুয়ারটা রিস্ক হই গেছে। পানি শুকাই গেলেতো বাইত চলি যামু। ঘরডে কাইত হই গেছে। বাড়িত যাই দুইডা ঠেকি দি আইছি। নয়তো পড়ি যাইব।
“ঘরডা ঠিক করা লাইগবো। নয়তো ঠেকি দি রাইখতে হইবো। টাকা মিলান ছাড়াতো কাজ করন যাইতো ন।”
বন্যার মধ্যে কিস্তি বন্ধ থাকলেও বন্যার পরেই সপ্তাহে ৮৫০ টাকা কিস্তি নিয়ে চিন্তিত সালা উদ্দিন বলেন, “খুব অসুবিধার মইধ্যে আছি। তাও এইখানে আইওনের পর কেউ দিতেছে খাইতেছি, কোনোরকম চইলতেছি।”
চন্দ্রগঞ্জ বাজার থেকে লক্ষ্মীপুরের দিকে যেতে কিছুদূরে রাস্তার বাঁ পাশে একটু ভেতরে কফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজ। কলেজ ফেলে সোজা পথে এগিয়ে গেলে বাঁ পাশে রাজাপুর গ্রাম আর ডান পাশে শেখপুর।
গ্রামের এই পথটিতে এখনও পানি আছে গোড়ালির উপরে। কিছু ঘর থেকে পানি নামলেও অনেক বাড়ির উঠানে এখনও কোমর ছুঁই ছুঁই পানি।
এ দুই গ্রামের প্রায় ১৯৭টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন কফিল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজে। পানি নামতে শুরু করায় কয়েক দিনের মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারবেন বলে আশা করছেন বাসিন্দারা।
ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীসহ ছয়জনের পরিবার নিয়ে নয় দিন ধরে আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন শেখপুরের আব্দুর রহিম। তিনি বলে, “সকালে গেছিলাম বাইত। গি দেহি পাক ঘরে পানি, লেন্ট্রিনেও পানি। এগুলি শুকাইলে চলি যাইয়ুম।”
আশ্রয়কেন্দ্রে ৯ দিনের মধ্যে প্রথম তিনদিন চাল পেয়েছেন, শেষ ছয়দিন শুকনা খাবার ছাড়া কিছু পাননি বলে জানালেন রহিম। তিনি বলেন, “এইটায় হয়না, বাজারতুন আনি মিলাই-জিলাই চইলতেছে। ঘরদুয়ারও হুয়ায় না যাইতামও পারিনা।”
একসময় কাঠমিস্ত্রীর কাজ করা রহিম এখন শ্বাসকষ্টের জন্য বেশি পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন না। কোনোরকম টুকটাক কাজ করেই চলে তার সংসার। এরমধ্যে বন্যার কারণে সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবে, সেই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
শেখপুরে আরেক বাসিন্দা মো. শাহজাহানের ঘরে অল্প পানি ওঠায় তিনি আর ঘর ছেড়ে যাননি। দুই সন্তানের মধ্যে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন সংসারে ছেলে-বাবা আর স্ত্রী।
দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে একটি সিঙ্গারা বিক্রির দোকানে কাজ করতেন শাহজাহান। বন্যার কারণে মালিক হোটেল বন্ধ রাখায় রোজগারও বন্ধ।
শাহজাহান বলেন, “কি কইরমু আর? পাইছি কিছু সামাইন্য। আর যেই দোহানে কাম করি মালিক চাইল এক বস্তা কিনি দিছে। পরে কাজ-কাম শুরু হইলে টাকা দি দিতে কইছে।”
লক্ষ্মীপুরের গ্রামগুলোতে পানি কমছে ধীর গতিতে। ফলে মানুষের কষ্ট প্রলম্বিত হচ্ছে। শহর থেকে বের হলেই প্রধান সড়ক থেকে দুই দিকে নেমে যাওয়া রাস্তাগুলোতে পানি রয়েছে।
চৌমুহনী থেকে লক্ষ্মীপুরে যাতায়াতের প্রধান সড়কে এখনও কোনো ধরনের যানবাহন চলছে না। বাস-ট্রাকসহ সকল যানবাহন নোয়াখালীর মাইজদী হয়ে চলাচল করছে। আর ওই বিকল্প পথ কিছুটা সরু হওয়ায় এবং সকল যানবাহন ওইপথে চলাচল করায় দীর্ঘ যানজট তৈরি হচ্ছে সেখানে।
Discussion about this post