শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে নয়াদিল্লীর কাছাকাছি একটি সামরিক ঘাঁটিতে অবতরণ করেছিলেন, যেখানে তাকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল অভ্যর্থনা জানান। হাসিনার পলায়নের পর থেকে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব বেড়ে চলেছে।
শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য ভারতের প্রতি ক্রমবর্ধমান আহবানে নয়াদিল্লীর অনীহা থেকে শুরু করে ভারত তার প্রতিবেশীকে হেনস্থা করার লক্ষ্যে ভিসা এবং নদীগুলোকে একইভাবে ব্যবহার করছে এমন অভিযোগ পর্যন্ত সবকিছুতেই ভারত-বিরোধী মনোভাব দৃশ্যমান।
সোমবার বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারতীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, হাসিনাকে বাংলাদেশেই প্রত্যর্পণ ও বিচার করতে হবে। একই দিনে এ দাবির প্রতিধ্বনি করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ কাদের। গত ৬ আগস্ট বিলুপ্ত জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন কাদের।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রিয়াজ বলেছেন যে, বাংলাদেশের জনগণ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে সঙ্ঘটিত বলপূর্বক গুম এবং বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে তার প্রত্যর্পণ চায়। তিনি বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক মেরামত করা সম্পূর্ণভাবে ভারতের দায়িত্ব, কারণ হাসিনার সরকার ভারতের সমর্থনের কারণেই টিকে ছিল।’
গত সপ্তাহে নোবেল বিজয়ী মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার কূটনৈতিক ভিসা বাতিল করে। এভাবে হাসিনা কতদিন ভারতে অবস্থান করতে পারবেন তা স্পষ্ট নয়। ভারত সরকার এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
গত বছর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুসারে, হাসিনা ২০০৯ সালে শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৬শ’ জনের বেশিকে গুমের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর উপর হত্যা ও গুমের সাথে জড়িত থাকার জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে।
বাংলাদেশে বন্যার জন্য ভারত কি দায়ী? বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, আসাম এবং মেঘালয় সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু অংশ আগস্টে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২৩ আগস্ট জানিয়েছে, প্রায় ১লাখ ৯০হাজার মানুষকে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১১টি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় দেশের বাকি অংশ থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশী সাইবার জগতে ছড়িয়ে পড়ছে যে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গুমতি নদীর উজানে দেশটির সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি আন্ত:সীমান্ত নদীর অন্যতম গোমতী নদীর দুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ায় বন্যা হয়েছে।
এই সপ্তাহের শুরুতে, বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা ইউনুসকে বলেছিলেন যে, পানির উচ্চ স্তরের কারণে বাঁধ স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেছে। বাংলাদেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা অবশ্য আল জাজিরাকে বলেছেন, অতীতের মতো ভারত তার প্রতিবেশীকে পানি ছাড়ার বিষয়ে কোনো সতর্কতা জারি করেনি। এই সতর্কতা, বাংলাদেশে মৃত্যু এবং ধ্বংস প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারতো।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে তাদের ভাগ করা নদীগুলি থেকে অধিকার অনুযায়ী আরও বেশি পানি উপলব্ধ করতে চেয়েছে। এই সংক্রান্ত চুক্তিটি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অচলাবস্থায় রয়েছে, যা ঢাকার জন্য একটি বেদনাদায়ক বিষয়। রিয়াজ বলেন, ‘এরআগে আমরা বর্ষাকালে দেখেছি বাংলাদেশ পানিতে ডুবে থাকে যেখানে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ যা চায় তা পায়না।’
কী হচ্ছে বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রগুলোতে? হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর নিরাপত্তা উদ্বেগের মধ্যে ভারত ঢাকায় তার ক‚টনৈতিক প্রদর্শনী কমিয়েছে। মঙ্গলবার দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের ঢাকা ও সাতক্ষিরায় ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র (আইভিএসিএস) বন্ধ ছিল। কয়েকশ মানুষ তাদের ভিসা প্রক্রিয়াকরণে বিলম্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তাদের পাসপোর্ট ফেরত দেওয়ার দাবি জানানোর একদিন পর এই ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কেন সমস্যায় পড়েছে? নয়াদিল্লী ও ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে শক্তিশালী কূটনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক উপভোগ করেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানে কাছ থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা পাইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তবে, সাম্প্রতিক দশকগুলিতে, অনেক সমালোচক ভারতকে অভিযুক্ত করেছেন যে, ভিন্নমতকে গ্রেফতার, দমন করা এবং নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ সহ হাসিনা সরকারের অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, ভারত তাকে সমর্থন করেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া সহ দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তারের পর বেশিরভাগ বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করার পর জাতীয় পার্টিকে নির্বাচন বর্জন করা থেকে বিরত রাখতে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশ সফরের উদাহরণ তুলে ধরে আলী রিয়াজ বলেন, ‘এটা আওয়ামী লীগকে শক্তি জুগিয়েছে।’
এদিকে, হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশের বৃহত্তম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বাংলাদেশি হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা ভারতে ক্ষোভের জন্ম দেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে আন্তর্জাতিকভাবেও মোদি সতর্কতা জারি করেন। বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ড. ইউন‚স ১৬ আগস্ট মোদিকে ফোন করে দেশে হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন।
হাসিনার দীর্ঘ শাসনের অবসানের কথা উল্লেখ করে রিয়াজ বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। ভারতীয়দের উচিত তাদের ইস্যুতে কান্নাকাটি করার পরিবর্তে তাদের নীতিগুলো পুনর্নির্মাণ করা। বাংলাদেশ যে সামনে এগিয়ে গেছে তা স্বীকার করুন এবং আগে বাড়–ন।’
Discussion about this post