নিউজ রুম: প্রবল দাবির মুখে পদত্যাগের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
শনিবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের যে দাবি উঠেছে, তার আঁচ পৌঁছে গেল বিচার বিভাগেও।
সকালে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের ফুলকোর্ট সভা ডাকার পর প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ডাকে আন্দোলনকারীরা হাই কোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নেন।
আন্দোলনকারীরা হাই কোর্টে ঘেরাও করে বিক্ষোভ শুরু করলে ফুল কোর্ট সভা স্থগিত করা হয়।
ওই সময় দাবি মানা না হলে প্রধান বিচারপতির বাসভবন ঘেরাওয়েরও হুঁশিয়ারি দেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে আন্দোলনকারীদের অবস্থান, বিক্ষোভ এবং স্লোগানের মধ্যেই প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের সিদ্ধান্তের খবর আসে।
আন্দোলনের সমন্বয়কের পোস্ট ও সকালের আন্দোলন
ফুলকোর্ট সভা আহ্বানের পরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক, বর্তমানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, “ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট ও নানান অপকর্মে জড়িত সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সরকারের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা না করে ফুলকোর্ট মিটিং ডেকেছেন।
“পরাজিত শক্তির যেকোনো প্রকার ষড়যন্ত্র বরদাশত করা হবে না। আইনজীবীরা এরইমধ্যে এর প্রতিবাদে জড়ো হয়েছেন। আমরা আগেই প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছিলাম। ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের উস্কানি দিলে এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করতে হবে।
“অনবিলম্বে বিনা শর্তে প্রধান বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ করুন এবং ফুল কোর্ট মিটিং বন্ধ করুন।”
আসিফ মাহমুদের পোস্টটি পরে সারজিস আলমসহ কয়েকজন সমন্বয়ক শেয়ার করেন।
এর মধ্যে আব্দুল হান্নান মাসুদ নামের এই আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক তার পোস্টে ‘হাই কোর্ট ঘেরাওয়ের ডাক দেন।
তিনি তার পোস্টে সবাইকে দ্রুত সকাল ১০টার মধ্যে কার্জন হলের গেটে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানান।
এরপর শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষাচত্বরের সামনে দিয়ে হাই কোর্টে প্রবেশ করেন। শিক্ষার্থীরা এনেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে ‘এক দুই তিন চার, বিচারপতি গদি ছাড়’, ‘হাসিনার দালালেরা হুঁশিয়ারি সাবধান’, ‘অ্যাকশন অ্যাকশন বিচারপতির বিরুদ্ধে ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘ঘেরাও ঘেরাও ঘেরাও হবে, বিচারপতির ভবন ঘেরাও হবে,’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
এরপর অবস্থান কর্মসূচিতে উপস্থিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “দুপুর ১টার মধ্যে ফ্যাসিবাদের মদদপুষ্ট প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সব বিচারপতিদের পদত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় আমরা প্রধান বিচারপতির বাসভবন ঘেরাও করব।”
এর পরপরই প্রধান বিচারপতির ডাকা ফুলকোর্ট সভা স্থগিত করার খবর পাওয়া যায়।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকের দায়িত্বে ছিলেন ওবায়দুল হাসান
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান দেশের চতুর্বিংশতিতম প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আসেন গত বছরের সেপ্টেম্বরে।
রাষ্ট্রপতির আদেশে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় গত ১২ সেপ্টেম্বর নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বিচারাঙ্গনের সর্বোচ্চ পদে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর স্থলাভিষিক্ত হন।
সংবিধানের নিয়ম অনুযায়ী, ৬৭ বছর বয়স, অর্থাৎ ২০২৬ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত তার প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল।
যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকের দায়িত্ব পালন করে আসা বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ইসি নিয়োগের সর্বশেষ সার্চ কমিটির প্রধান ছিলেন।
১৯৫৯ সালের ১১ জানুয়ারি নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ থানার ছয়াশী (হাটনাইয়া) গ্রামে ওবায়দুল হাসানের জন্ম। তার বাবা আখলাকুল হোসাইন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। তার মায়ের নাম বেগম হোসনে আরা হোসাইন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পর আইনে লেখপড়া করেন ওবায়দুল হাসান। এলএলবি শেষ করে ১৯৮৬ সালে তিনি আইনজীবী হিসেবে জেলা বারের তালিকাভুক্ত হন।
পরে ১৯৮৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের এবং ২০০৫ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ওবায়দুল হাসান।
সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ডেপুটি এটর্নি জেনারেল হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০০৯ সালের ৩০ জুন অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে যোগ দেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। নিয়ম অনুযায়ী, দুই বছর পর তার নিয়োগ স্থায়ী হয়।
হাই কোর্টে দায়িত্ব পালন কালেই ২০১২ সালের ২৩ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারক হিসেবে যোগ দেন দেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর থেকে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই সময়ে ট্রাইব্যুনাল থেকে ১১টি যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় আসে।
২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারক হিসেবে নিয়োগ বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
তার ভাই সাজ্জাদুল হাসান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের নেত্রকোণা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব তিনি।
Discussion about this post