ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। বিশ্বজুড়ে তিনি আলোচিত তাঁর ক্ষুদ্রঋণ ধারণা, সামাজিক ব্যবসা ও তিন শূন্য তত্ত্বের জন্য। একদা ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই জোবরা গ্রাম। এ গ্রামের দরিদ্র মানুষের ভাগ্যবদলের স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেন গ্রামীণ ব্যাংক। তাঁর অভিনব ক্ষুদ্রঋণ ধারণার সুফল পান গ্রামের দরিদ্র নারীরা। দেশে দেশে তাঁর এ ‘মাইক্রো-ক্রেডিট’ ব্যাংকিং আলোড়ন তোলে। ইউনূস হয়ে ওঠেন গরিবের ব্যাংকার। তিনি নোবেল পুরস্কার ছাড়াও দেশে-বিদেশে অসংখ্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত। ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা থেকে আজ পর্যন্ত ড. ইউনূসকে নানা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ৮ আগস্ট ২০২৪ হলেন দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। লিখেছেন- তানভীর আহমেদ
গরিবের ব্যাংকারের দ্যুতিময় ব্যক্তিত্ব
নোবেল শান্তি পুরস্কার তাঁকে বিশ্ব পরিচিতি এনে দেয়। ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক ও বরেণ্য অর্থনীতিবিদ হিসেবেও তিনি দেশে দেশে প্রশংসিত
ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। ক্ষুদ্রঋণ নামক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জনক হিসেবে গোটা বিশ্বে তিনি সমাদৃত।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৪০ সালের ২৮ জুন ব্রিটিশ ভারতের বাংলা প্রেসিডেনসির চট্টগ্রামের হাটহাজারি এলাকার বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তাঁর বাবা হাজী দুলা মিয়া সওদাগর ছিলেন একজন জহুরি, এবং তাঁর মা সুফিয়া খাতুন। তাঁর শৈশব কাটে গ্রামে। ১৯৪৪ সালে তাঁর পরিবার চট্টগ্রাম শহরে চলে আসে। তিনি তাঁর গ্রামের স্কুল থেকে লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং পূর্ব পাকিস্তানের ৩৯ হাজার ছাত্রের মধ্যে ১৬তম হন। বয় স্কাউট হিসেবে ১৯৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারত এবং ১৯৫৫ সালে কানাডায় জাম্বোরিতে অংশগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশোনার সময় তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৬০ সালে বি এ ও ১৯৬১ সালে এম এ সম্পন্ন করেন। স্নাতক শেষ করার পর গবেষণা সহকারী হিসেবে অর্থনীতি ব্যুরোতে যোগ দেন। তিনি ১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম কলেজে অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য ফুলব্রাইট স্কলারশিপ লাভ করেন। ১৯৭১ সালে ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট থেকে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অধ্যাপক ইউনূস মার্ফ্রিসবোরোতে মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এ পদে কর্মরত ছিলেন।
দরিদ্রতার বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম শুরু করেন ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের সময়। তিনি বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে। সে সময় তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে। গরিব বাংলাদেশিদের মধ্যে ঋণ দেওয়ার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে গ্রামীণ ব্যাংক ৫.৩ মিলিয়ন ঋণগ্রহীতার মধ্যে ৫.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করে। ঋণের টাকা ফেরত নিশ্চিত করার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক ‘সংহতি দল’ পদ্ধতি ব্যবহার করে। একটি অনানুষ্ঠানিক ছোট দল একত্রে ঋণের জন্য আবেদন করে এবং এর সদস্যবৃন্দ একে অন্যের জামিনদার হিসেবে থাকে ও একে অন্যের উন্নয়নে সাহায্য করে। ব্যাংকের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দরিদ্রতা দূর করার জন্য ব্যাংক অন্যান্য পদ্ধতিও প্রয়োগ করে। ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে যোগ হয় গৃহঋণ, মৎস্য খামার এবং সেচ ঋণ প্রকল্পসহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা। তাঁর ক্ষুদ্রঋণ ধারণা ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রসার সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে। ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক। এই অনন্য সম্মান তাঁকে বিশ্ব পরিচিতি এনে দেয়।
ড. ইউনূস ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা থেকে আজ পর্যন্ত ড. ইউনূসকে নানা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে তাঁকে ও গ্রামীণ ব্যাংককে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়। তবে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ও দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। গত ৮ আগস্ট তিনি দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
গ্রামীণ ব্যাংক এবং দরিদ্র নারীদের দিনবদলের কথা
দরিদ্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য উন্নত বিশ্ব, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য শিল্পোন্নত দেশগুলো গ্রামীণের এই মডেল ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ হয়…
সম্পূর্ণ নতুন এক ধারণা নিয়ে ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষুদ্রঋণের ধারণার মাধ্যমে সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে এটি…
গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই ক্ষুদ্রঋণ ধারণার মূল লক্ষ্যই ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়া। দেশের বাইরে পড়াশোনা শেষে ড. ইউনূস প্রথমে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে। নতুন বিভাগ হওয়াতে তখন বিভাগে তেমন বেশি কাজ ছিল না। সে সময় তিনি আশপাশের গ্রামে ঘুরতেন। সেখানকার মানুষের জন্য কিছু করতে চাইতেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ‘রুরাল ইকনোমিকস প্রোগ্রামের’ প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তখন জোবরা এবং সংলগ্ন গ্রামগুলোতে শুরু করেছিলেন একটি মাঠ গবেষণা, যেখানে তিনি যাচাই করতে চেয়েছিলেন সমাজের একেবারে নিচুতলার মানুষের মধ্যে ব্যাংকঋণ সরবরাহের সম্ভাব্যতা। সেখানে শুরুতে তেভাগা পদ্ধতি কৃষকদের খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমের কার্যক্রম শুরু করেন ড. ইউনূস। যার নাম ছিল নবযুগ তেভাগা খামার। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেছিলেন, “জমি যার সে ফসলের তিন ভাগের এক ভাগ পাবে। আর যে বীজ দেবে সার দেবে সে পাবে এক ভাগ। আর চাষ করবে, পানি দেবে সে পাবে এক ভাগ। এ রকম করে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম।’’ পরে গ্রামের অবহেলিত নারী ও পুরুষদের নিয়ে একটা সমিতি শুরু করেন। সেই সমিতিতে সঞ্চয় করত সবাই। এ কৃষকদের খামার থেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ভিত্তি রচিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। পরবর্তীতে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা নিয়ে বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিক জন্ম হয় গ্রামীণ ব্যাংকের। গ্রামীণ ব্যাংক মূলত ভূমিহীন এবং দরিদ্র নারীদের পাঁচজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গঠনের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে এবং এ ঋণের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ব্যাংকের পরিধি বাড়ানো হয়। ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে যোগ হয় গৃহঋণ, মৎস্য খামার এবং সেচ ঋণ প্রকল্পসহ অন্যান্য ব্যাংকিং ব্যবস্থা। দরিদ্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সাফল্য উন্নত বিশ্ব, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য শিল্পোন্নত দেশগুলো গ্রামীণের এ মডেল ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ হয়।
অধ্যাপক ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের এ কার্যক্রম বিস্তৃতি লাভ করলে ২০০৬ সালে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন অধ্যাপক ড. ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক।
সামাজিক ব্যবসার অভিনব ধারণা
সামাজিক ব্যবসার প্রবক্তা বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সামাজিক ব্যবসা হলো এমন উদ্যোগ, যেখান থেকে মুনাফা বা লভ্যাংশ নেওয়া যায় না। উদ্যোক্তারা মুনাফা পুনর্বিনিয়োগ করেন।
সামাজিক ব্যবসার প্রবক্তা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সামাজিক ব্যবসা হলো এমন উদ্যোগ, যেখান থেকে মুনাফা বা লভ্যাংশ নেওয়া যায় না। উদ্যোক্তারা মুনাফা পুনর্বিনিয়োগ করেন। প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মতোই পরিচালিত হয়। সবার অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করাই এ ব্যবসার লক্ষ্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতে বেকারত্ব দূর করতে সামাজিক ব্যবসা একটি কার্যকর ব্যবস্থা। বেকারত্ব এখন পুঁজিবাদের নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর মতে, এ সামাজিক ব্যবসা দিয়েই বর্তমান বিশ্বের বেকারত্বের সমাধান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সামাজিক ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ছে। ইউরোপের দেশ আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানায় সামাজিক ব্যবসার আওতায় বৃদ্ধনিবাস করা হয়েছে। ২০১২ সালে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ বৃদ্ধনিবাসে ২৫০ জন বয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন। শুধু আলবেনিয়া নয়; নেপাল, ভিয়েতনাম, চীন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, হাইতি, যুক্তরাষ্ট্র, উগান্ডাসহ পৃথিবীর দেশে সামাজিক ব্যবসার প্রসার ঘটছে।
তাঁর কাজ নিয়ে গবেষণা বিশ্বজুড়ে
কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ড. ইউনূসের জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে
এখন পর্যন্ত দারিদ্র্যদূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক ব্যবসার মডেল পৃথিবীর ৪০টির বেশি দেশে ১৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠান ধারণ করে চলেছে। বিভিন্ন দেশে ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তাঁর নামে ‘ইউনূস সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে ড. ইউনূসের চিন্তা, কাজ, ভবিষ্যৎ লক্ষ্য ও তাঁর জীবনাদর্শ নিয়ে গবেষণা হয়। ২৪টি দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. ইউনূস ৬০টির মতো সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন। কানাডা ও জাপানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে তাঁর জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত কয়েক দশকে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী, গ্রামীণ শক্তিসহ ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
আলোচিত তিন শূন্য তত্ত্ব
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া আয়োজিত একটি জন-বক্তৃতা অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময় তাঁর ‘তিন শূন্য’ ধারণার ব্যাখ্যা করেছিলেন…
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া আয়োজিত একটি জন-বক্তৃতা অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময় তাঁর ‘তিন শূন্য’ ধারণার ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর ‘তিন শূন্য তত্ত্ব’ হচ্ছে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা। আর তা অর্জনে লাগবে তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসা। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াও গোটা বিশ্বেরই চোখ টেকসই উন্নয়নে। এ ক্ষেত্রে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ। এই তত্ত্বের ব্যাপারে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের ভাষ্য, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজেই দারিদ্র্য সৃষ্টি করে এবং এ ব্যবস্থার অধীনে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়। মানুষ এককভাবে দারিদ্র্য তৈরি করে না, আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর ভিতরেই তৈরি হয় দারিদ্র্য।’ এ লক্ষ্য অর্জনে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসায়। তাঁর মতে, ভালো চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা তৈরিতে জোর দিতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা জন্মেছি সমস্যা সমাধানের জন্য। কারও অধীনে চাকরি করার জন্য নয়। তাই তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হতে হবে। কারও অধীনে নয়, বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েই।’
‘সামাজিক ব্যবসা দিবস-২০১৫’ উদযাপনকালে প্রধান বক্তার বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিটি মানুষকে তাঁর সৃজনশীল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। আয় বৈষম্য শুধু আয় বৈষম্য-ই নয়, সম্পদের বৈষম্যও বটে। এ পৃথিবীতে কারও কারও সম্পদের পাহাড় অথচ কেউ কেউ সম্পদ থেকে নিগৃহীত। সমাজের এ বৈষম্য দূর করতে সৃজনশীল ক্ষমতা প্রয়োগের বিকল্প নেই।’
দেশে দেশে যত পুরস্কার-সম্মাননা
১০ ডিসেম্বর ২০০৬, অসলো সিটি হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে নোবেল পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়
শান্তিতে নোবেল জয়
গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ ধারণা গোটা বিশ্বেই আলোড়ন তুলেছিল। দেশে তো বটেই, বিশ্বের নানা প্রান্তে এ ব্যাংকের মডেল অনুসরণ করে দরিদ্র মানুষের ভাগ্যবদলের গল্প লেখা হয়েছে। হয়েছে গবেষণা। বিশ্বের সেরা অর্থনীতিবিদরা এ নিয়ে নিবন্ধ লিখেছেন ও চর্চার কথা বলেছেন। কীভাবে কর্মসংস্থান তৈরি করা যায়, উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা যায় সে পথ তিনি দেখিয়েছেন। এসব কারণেই গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস সর্বজনীন হয়ে ওঠেন। তাঁর দিকে চোখ পড়ে বিশ্ববাসীর। যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ গোটা বিশ্বের সামনে তা মোকাবিলার একটি পথ দেখিয়েছেন তিনি। এসব বিবেচনায় অধ্যাপক ড. ইউনূস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এ পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল কমিটি বিশ্ববাসীকে তাঁর অবদানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছে, সমাজের একেবারে প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাঁর প্রচেষ্টা ও অর্থনৈতিক ধারণা অনবদ্য। সহজ শর্তে ও ছোট আকারের ঋণ প্রদান যা ‘মাইক্রো-ক্রেডিট’ ধারণার মাধ্যমে তিনি দরিদ্র মানুষের জন্য কর্মসংস্থান ও জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন। এ দরিদ্র মানুষের আয়ের পথ খুলে দিয়েছেন ও ভাগ্যবদলের পথ দেখিয়েছেন। ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে এ উদ্যোগ বড় পরিসরে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও দরিদ্রতা দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন ড. ইউনূস।
ড. ইউনূসকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পরিয়ে দেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা
অধ্যাপক ড. ইউনূস বিশ্ব খাদ্য পুরস্কারসহ বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকসহ প্রায় ১৪৫টি পুরস্কার অর্জন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড (১৯৭৮), রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার (১৯৮৪), কেন্দ্রীয় ব্যাংক অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৫), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮৭), আগা খান অ্যাওয়ার্ড (১৯৮৯), কেয়ার পুরস্কার (১৯৯৩), নোবেল পুরস্কার (শান্তি) (২০০৬), মানবহিতৈষণা পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৩), মুহাম্মদ সাহেবুদ্দিন বিজ্ঞান (সামাজিক অর্থনীতি) পুরস্কার, শ্রীলঙ্কা (১৯৯৩), রিয়াল এডমিরাল এম এ খান স্মৃতি পদক, বাংলাদেশ (১৯৯৩), বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৪), পিফার শান্তি পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৪), ড. মুহাম্মাদ ইব্রাহিম স্মৃতি স্বর্ণ পদক, বাংলাদেশ (১৯৯৪), ম্যাক্স সছমিধেইনি ফাউন্ডেশন ফ্রিডম পুরস্কার, সুইজারল্যান্ড (১৯৯৫), ঢাকা মেট্রোপলিটন রোটারারি ক্লাব ফাউন্ডেশন পুরস্কার, বাংলাদেশ (১৯৯৫), আন্তর্জাতিক সাইমন বলিভার পুরস্কার (১৯৯৬), ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয় বিশিষ্ট অ্যালামনাই পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৬), আন্তর্জাতিক একটিভিটিস্ট পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৭), প্লানেটরি কনশিয়াশনেস বিজনেস ইনোভেশন পুরস্কার, জার্মানি (১৯৯৭), হেল্প ফর সেলফ হেল্প পুরস্কার, নরওয়ে (১৯৯৭), শান্তি মানব পুরস্কার (ম্যান ফর পিস অ্যাওয়ার্ড), ইতালি (১৯৯৭), বিশ্ব ফোরাম পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৭), ওয়ান ওয়ার্ল্ড ব্রডকাস্টিং ট্রাস্ট মিডিয়া পুরস্কার, যুক্তরাজ্য (১৯৯৮), দ্যা প্রিন্স অব আউস্তুরিয়া অ্যাওয়ার্ড ফর কনকর্ড, স্পেন (১৯৯৮), সিডনি শান্তি পুরস্কার, অস্ট্রেলিয়া (১৯৯৮), অযাকি (গাকুডো) পুরস্কার, জাপান (১৯৯৮), ইন্দিরা গান্ধী পুরস্কার, ইন্ডিয়া (১৯৯৮), জাস্টটি অব দ্য ইয়ার পুরস্কার, ফ্রান্স (১৯৯৮), রোটারারি অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়ার্ল্ড আন্ডারস্ট্যান্ডিং, যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯৯), গোল্ডেন পেগাসাস অ্যাওয়ার্ড, ইতালি (১৯৯৯), রোমা অ্যাওয়ার্ড ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান, ইতালি (১৯৯৯), রাথিন্দ্রা পুরস্কার, ইন্ডিয়া (১৯৯৮), অমেগা এ্যাওয়ার্ড অফ এক্সিলেন্সি ফরব লাইফ টাইম এচিভমেন্ট, সুইজারল্যান্ড (২০০০), অ্যাওয়ার্ড অব দ্য মেডেল অব দ্য প্রেসিডেনসি, ইতালি (২০০০), কিং হুসেইন হিউম্যানিটারিয়ান লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড, জর্ডান (২০০০), আই ডি ই বি গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ (২০০০), আরতুসি পুরস্কার, ইতালি (২০০১), গ্র্যান্ড প্রাইজ অব দ্য ফুকুওকা এশিয়ান কালচার পুরস্কার, জাপান (২০০১), হো চি মীণ পুরস্কার, ভিয়েতনাম (২০০১), আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পুরস্কার ‘কাজা ডি গ্রানাডা’, স্পেন (২০০১), নাভারা ইন্টারন্যাশনাল এইড অ্যাওয়ার্ড, স্পেন (২০০১), মহাত্মা গান্ধী পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র (২০০২), বিশ্ব টেকনলজি নেটওয়ার্ক পুরস্কার, যুক্তরাজ্য (২০০৩), ভলভো পরিবেশ পুরস্কার, সুইডেন (২০০৩), জাতীয় মেধা পুরস্কার, কলম্বিয়া (২০০৩), দ্য মেডেল অব দ্য পেইন্টার অসওয়াল্ড গুয়ায়াসামিন পুরস্কার, ফ্রান্স (২০০৩), তেলিছিনকো পুরস্কার, স্পেন (২০০৪), সিটি অব অরভিতো পুরস্কার, ইতালি (২০০৪), দ্য ইকোনমিস্ট ইনোভেশন পুরস্কার, যুক্তরাষ্ট্র (২০০৪), ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিল অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্র (২০০৪), লিডারশিপ ইন সোশ্যাল অন্টাপ্রিনেয়ার অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাষ্ট্র (২০০৪)।
Discussion about this post